পুরান ঢাকার বংশাল পার্ক এখন বিরিয়ানির হাউস। কথা ছিল পার্কে বসবে চাকাযুক্ত ভ্যানে কফিশপ। ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) শর্ত ভঙ্গ করে চলছে ইজারাদারের ইচ্ছামতো। বেঞ্চের ওপর নির্মিত হয়েছে স্থায়ী কাঠামো। পানির স্বল্পতায় বন্ধ রয়েছে পানির ফোয়ারা। পাশাপাশি হাঁটার জায়গা দখল করে সাজানো হয়েছে টেবিল-চেয়ার।
স্থানীয়রা বলছেন, বহু বছর ধরেই এটি পার্ক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এখানে লাইব্রেরি ছিল, ১০ থেকে ১২টি বসার জন্য বেঞ্চ ছিল। প্রায় সময় এখানে কাটানো যেত অবসর সময়। এখন হাঁটার জায়গাও আর নেই। সর্বশেষ পার্কের উন্নয়নকাজ শেষ করে তা সবার জন্য খুলে দেয়া হলেও এটি আর পার্ক নেই। বসানো হয়েছে বিরিয়ানির দোকান, চলছে খাওয়া-দাওয়া। পার্কটি ব্যবহারের উপযোগী করার দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।
এদিকে স্থানীয় কাউন্সিলর বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনকে জানালেও নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। ইজারাদার বলছেন, বৈধভাবেই কফিশপের পাশাপাশি বিরিয়ানি বিক্রি করছেন তারা। কাস্টমারের অভাবে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ বলছে, এ পার্কে চাকাযুক্ত ভ্যানে কফিশপ পরিচালনার জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তারা পার্কটি পরিষ্কার রাখবে ও এর দেখভাল করবে। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে শর্ত ভঙ্গের কারণে ইজারা বাতিল করা হবে।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, বিরিয়ানি, কাচ্চিসহ যেকোনো খাবারের জন্য বিখ্যাত পুরান ঢাকা। অলিগলিতে মেলে মুখরোচক খাবারের দোকান। এ এলাকাটি ঢাকার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের একটি। পর্যাপ্ত খাবারের আয়োজন থাকলেও অবসর সময় কাটানোর জন্য এখানকার বাসিন্দাদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ বা পার্ক নেই বললেই চলে। তারপরও বংশালের যে পার্কটি রয়েছে তাতেও গড়ে উঠেছে বিরিয়ানির দোকান।
পার্কটি ঢাকা দক্ষিণ সিটির মোট চারটি ওয়ার্ডের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। বংশাল চার রাস্তার মোড়ে ত্রিকোণ আকৃতির পার্কটির তিনদিকে মোজায়েকযুক্ত বেঞ্চ রয়েছে। পার্কের নকশায় পানির ফোয়ারা ছিল। তবে তা দেখে এখন বোঝার উপায় নেই। কারণ পানির ফোয়ারার জায়গায় পাশের তিন দিকের বেঞ্চের ওপর ও একদিকের ফাঁকা জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি খাবার রেস্তোরাঁ। হাজী আহসান উল্লাহ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ পার্কের ইজারা নেয়।
সেখানে কফিশপ বসানোর কথা থাকলেও বসানো হয়েছে খাবারের দোকান। হাঁড়িতে রাখা হয়েছে বিরিয়ানি, খাবার গরম রাখার জন্য চুলার ব্যবস্থাসহ রয়েছে রেফ্রিজারেটর। সাজিয়ে রাখা হয়েছে টেবিল-চেয়ার। বাইরে থেকে খাবার রান্না করা হয় বলে জানান ইজারাদার। ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় সেখানে হাঁটার জায়গা নেই, এমনকি পার্কটিতেও সাধারণের জন্য হাঁটার জায়গা নেই। টেবিল-চেয়ার সাজিয়ে রাখার ফলে বাসিন্দারা হাঁটতে-বসতে পারছেন না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তারা বলছেন, দেশ স্বাধীনের আগ থেকেই এখানে পার্ক ছিল। হাঁটা-বসার ব্যবস্থা ছিল, লাইব্রেরি ছিল। কিন্তু মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সময় তিনি পার্কটি সংস্কার করে পার্কের ভেতরে শান্তির প্রতীক দুটি পায়রা ও পানির ঝরনা স্থাপন করেন। ২০২০ সালে মেয়র সাঈদ খোকন পার্কটির উন্নয়ন করে আবারও জনসাধারণদের জন্য খুলে দেন। কিন্তু পার্কটি এখন আর পার্ক নেই। পার্কটি এখন বিরিয়ানির দোকান। মাদকাসক্তদের আড্ডা নেই কথা সত্য, তবে পার্কে এখন বসার মতো পরিবেশও নেই।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৫, ৩৩, ৩২ ও ৩৪ নম্বরসহ মোট চারটি ওয়ার্ডের মাঝে বংশালের এ পার্ক। ২০২০ সালে জলসবুজে ঢাকা পার্ক প্রকল্পের আওতায় পার্কটির সংস্কার করে জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। এ সময় ক্ষুদ্রাকৃতির পার্কটিতে ওয়াকওয়ে, সবুজ ঘাসের উঁচু স্তর, বসার সিট, লাইট, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (পানির ফোয়ারা) ব্যবস্থা করা হয়।
হাজী এবাদুল্লাহ বিরিয়ানি হাউজের মালিক লিটন বাবুর্চি আমার সংবাদকে বলেন, বংশাল পার্কে হাজী আহসান উল্লাহ কফিশপের জন্য সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছিলেন। সাড়ে তিনমাস হলো আমি তার কাছ থেকে দোকান ভাড়া নিয়ে বিরিয়ানি হাউজ চালাচ্ছি। পাশাপাশি কফিশপের দোকানও চালাচ্ছি। দোকান ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাজী আহসান উল্লাহর কাছের লোক শাকিল বাবু এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। আপনাকে তার নম্বর দিচ্ছি তার সাথে কথা বলেন।
বংশাল পার্কটির মূল ইজারাদার হাজী আহসান উল্লাহ এন্টারপ্রাইজ। তার মাধ্যমে পার্কটি পরিচালনা করছেন ৩৪নং ওয়ার্ড যুবলীগের (২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত) সাবেক দপ্তর সম্পাদক শাকিল। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, হাজী আহসান উল্লাহ ও আমিসহ মোট ছয়জন মিলে পার্কটি পরিচালনা করছি। আমরা সর্বোচ্চ রেট (তিন লাখ টাকার ওপর) দিয়ে এক বছরের জন্য পার্কটি ইজারা নিয়েছিলাম। আগামী জানুয়ারির শেষ দিকে ইজারার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আমরা যে পরিমাণ টাকা দিয়ে ইজারা নিয়েছি তা এখনো উঠাতে পারেনি। আমরা অনেক লোকসানে আছি। আমরা অবৈধভাবে দোকান বসাইনি। কফিশপের পাশাপাশি একটি হাঁড়িতে বিরিয়ানি বিক্রি করছি। পাশাপাশি তা গরম রাখার জন্য একটি চুলা ব্যবহার করছি। তবে এখানে বিরিয়ানি রান্না হয় না। রাস্তার কাজ চলায় ও কাস্টমার কম থাকায় কয়েকদিন ধরে দোকান বন্ধ রেখেছি। কয়েকদিনের মধ্যে খাবারের দোকান পুনরায় চালু করা হবে। আগে পার্কে নেশাগ্রস্তদের আড্ডা বসত, এখন আর বসতে পারে না। চেয়ার বসিয়েছি কথা সত্য তবে সবাইকে বসতে দেয়া হয়।
এ বিষয়ে ৩৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আবু সাঈদ আমার সংবাদকে বলেন, বংশাল পার্কে বসা দোকানের বিষয়ে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে জানিয়েছি। যদি তারা কোনো পদক্ষেপ না নেয় তবে লিখিতভাবেও জানানো হবে বলে জানান তিনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন আমার সংবাদকে বলেন, বংশাল পার্কে বসা দোকানের বিষয়ে তিনি অবগত নন, যদি কেউ অভিযোগ করেন তাহলে শর্ত ভঙ্গের কারণে ইজারা বাতিলসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগেও একবার তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে কাউকে লিখিত অভিযোগ জানাতে হবে বলে জানান তিনি।