প্রশাসনে চাপা আতঙ্ক

বেলাল হোসেন প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২২, ০১:৩৪ এএম

তথ্য সচিবের মতো একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে সম্প্রতি বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোয় গত কয়েকদিন ধরেই জনমনে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রশাসনের সর্বোচ্চ কেন্দ্র সচিবালয়ে বড় কর্তাদের মাঝে দেখা গেছে চাপা আতঙ্ক। বেশিরভাগ কর্মকর্তা তাদের কাজের বাইরে এ বিষয়ে তেমন কোনো কথা বলতেই রাজি হচ্ছেন না। কয়েকটা মন্ত্রণালয় ঘুরে সচিব এবং অতিরিক্ত সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

তারা জানান, স্যাররা অফিস করছেন তবে দর্শনার্থীদের সাথে সাক্ষাতের বিষয়ে সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে তারপর দেখা করছেন। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তথ্য মন্ত্রণালয়ে যে বিষয় ঘটে গেল তাতে সবার মাঝেই একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

মানসিক চাপে দৈনন্দিন কাজে ধীরগতি হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসন অনুবিভাগের এক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, পত্রিকায় যেভাবে লেখালেখি হচ্ছে তাতে সবাই একটু চাপে আছেন। তবে মন্ত্রণালয়ের কাজ স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। আমরা সতর্ক আছি।  

মন্ত্রণালয়ের বাইরে অধিদপ্তর, বিভাগের কর্মকর্তারাও বাধ্যতামূলক সচিব পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তার অবসরের বিষয় নিয়ে সচিবালয়ে সহকর্মীদের সাথে কথা বলছেন বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের আচরণগত কারণে সচিবালয়ের বাইরে দপ্তরগুলোতে দায়িত্বরত আছেন। বর্তমানে সদ্য অবসরে যাওয়া তথ্য সচিব মকবুল হোসেনের কি কারণে এ পরিণতি তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারাও কেউ কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করেছেন।

সচিবালয়ের অনেক কর্মকর্তা বলেছেন, এখন যেকোনো কাজ করার আগে অতি সতর্কতার সাথে এগোতে হবে। এ বিষয়ে জানার জন্য একজন অতিরিক্ত সচিবের সাথে তার রুমে  কথা বলতে গেলে অবসরের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য নাই বলে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, আমার মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যু থাকলে কথা বলতে পারেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সচিব আমার সংবাদকে বলেন, বিষয়টা স্পর্শকাতর। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। পরে তিনি বলেন, আপনাদের মতো আমিও তো বিষয়টা দেখেছি। এটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাজ তারাই এটা ভালো বলতে পারবে। সচিব বলেন, আইন অনুযায়ী আমরা যেমন আমাদের স্টাফদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারি। তেমনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাদের কর্মকর্তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি বিধান আছে চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হলে কেউ নিজেও স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারেন, আবার সরকার ইচ্ছা করলেও কাউকে অবসর দিতে পারে। বিধিবিধান মেনেই তথ্য সচিবকে অবসর দেয়া হয়েছে। এর আগেও ২০০৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হেয় করে কবিতা লেখার অভিযোগে তৎকালীন তথ্যসচিব আ ত ম ফজলুল করিমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল সরকার। তিনি লেখক মহলে আবু করিম নামে পরিচিত ছিলেন।

২০১৪ সালে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার কারণে পাঁচ সচিবকে একসঙ্গে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল সরকার। সেসব সচিব আইন ভঙ্গ করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ পর্যন্ত করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন।

এ বিষয়ে গবেষক ও সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, সরকারি চাকরি ২৫ বছর হলে কেউ ইচ্ছে করলে নিজে দরখাস্ত দিয়ে রিটায়ার্ডমেন্টে যেতে পারেন আবার সরকারও রিটায়ার্ড করাইতে পারেন।

তিনি বলেন, এই সরকারের আমলে এর আগে ২০০৯ সালে একজন তথ্য সচিব তার ডাক নাম ছিল আবু করিম তাকেও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। উনার অবসরের কারণটা জানা গেছে উল্লেখ করে সাবেক সচিব বলেন, উনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিয়ে আপত্তিকর কবিতা লিখেছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে উনি (আবু করিম) সম্ভবত একটা কবিতার বই বের করেছিলেন।

কর্মকর্তাদের ভিতরে আতঙ্ক কাজ করছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা তো স্বাভাবিক থাকেই। একজন কর্মকর্তাকে সরকার বিদায় করল তার সঠিক কারণ অন্যরা যদি না জানেন তারা মনে করতে পারেন অন্য কারো ওপর এরকম অবস্থা হতেই পারে। আবার যদি সঠিক কারণটা জানা যায় তাহলে এটা সমস্যা হয় না।

প্রসঙ্গত, গত ১৬ অক্টোবর সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে তথ্য সচিব মকবুল হোসেনকে অবসর প্রদান করা হয়। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে। তবে যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হবে।