ঢাকার কেরানীগঞ্জে একটি কিন্ডারগার্টেনে নার্সারির শিক্ষার্থী সিফাত রায়হান। নার্সারির শিক্ষার্থী হলেও বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের পাশাপাশি প্রায় এক ডজন বই পড়তে হয় তাকে। বইয়ের সংখ্যা বেশি হওয়াতে অতিরিক্ত মানসিক চাপের শিকার হচ্ছে বলে জানান এ শিক্ষার্থীর অভিভাবক। এদিকে মতিঝিলের আরেকটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী সুমাইয়া তাপতিলার অভিভাবকও একই অভিযোগ করছেন।
তাদের অভিযোগ— অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে তাদের শিশু প্রায় সবসময় একাকিত্বে ভুগছেন। একই সাথে ক্লাস আর হোমওয়ার্কের চাপে শিশুদের জীবনে নদী, ফুল, আকাশ, গান, ছুটোছুটি অথবা খেলাধুলারও কিছু নেই। আছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া কিন্ডারগার্টেনের এসব শিক্ষার্থীদের একদিকে যেমন মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অপরদিকে অতিরিক্ত বইয়ের চাপে বিবর্ণ হচ্ছে শৈশব।
অনুসন্ধান বলছে— অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা নিয়ে এমন অভিযোগ শুধু সিফাত রায়হান অথবা সুমাইয়া তাপতিলার পরিবারের নয়। রাজধানীর অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব কিন্ডারগার্টেন রীতিমতো এক আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়াই পাঠদানে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের দিয়েই চলছে রমরমা বাণিজ্য। নিজস্ব শিক্ষাক্রম না থাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ক্লাসে এতগুলো বইয়ের পড়া ঠিকমতো পাঠদান করতে না পারায় অভিভাবকরাও শিশুদের নিয়ে ছুটছেন বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে। কেউবা আবার বাড়িতেই রাখছেন একাধিক গৃহশিক্ষক। ফলে কিন্ডারগার্টেনের জনক বিখ্যাত জার্মান শিশু-শিক্ষানুরাগী ফ্রেডরিক উইলহেম অগাস্ট ফ্রোয়েবলের খেলার ছলে পাঠদান করতে শুরু হওয়া কিন্ডারগার্টেন রূপ নিচ্ছে শিশুযুদ্ধে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবসায়িক কারণে শিক্ষাকে অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীরণের কারণে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ওপর প্রতি বছর বাড়ছে বইয়ের বোঝা। প্রাথমিকের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই অতিরিক্ত প্রস্তুতির জন্য বাড়ির শিক্ষক, কোচিং সেন্টার, বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধান সব মিলিয়ে শিশুর প্রাণ হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত। আর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো মাথার ওপর ঝুলতে থাকে বিভিন্ন পরীক্ষা। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন নামিদামি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের এমন অভিজ্ঞতা বেশ পুরনো।
তবে কোমলমতি শিশুদের অতিরিক্ত বইয়ের চাপ শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। একই সাথে প্রতিনিয়ত ভারী বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে শিশুরা দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্ডারগার্টেনগুলোতে অযাচিত বই পাঠ্যভুক্ত করা হচ্ছে যা- বেশ উদ্বেগের। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গজিয়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশও মানছে না।
সমপ্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় দেখা গেছে— শিশুদের জন্য স্কুলে ব্যবহূত বেঞ্চ বা চেয়ারগুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এছাড়া প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা দীর্ঘসময় ভারী ব্যাগ বহনের কারণে অনেকের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়, পিঠে-ঘাড়ে চাপ পড়ে। অল্প বয়স থেকেই তারা মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়ে বেড়ে ওঠে। পরবর্তীতে এসব শিক্ষার্থী ৪০-৫০ বছরে পৌঁছালে অনেকেই মেরুদণ্ডজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে— নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সেবার নামে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়া এসব কিন্ডারগার্টেন থেকে নামে-বেনামে ডজন খানেক বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। চড়াদামে বিক্রি করা এসব বইয়ের বেশির ভাগই নির্ধারিত বেসরকারি ভূঁইফোড় প্রকাশনার। ৩০ থেকে ৪০ পৃষ্ঠার বইও তিন থেকে পাঁচশ টাকা বিক্রি করতে দেখা গেছে। বইগুলো ক্রয়ের ক্ষেত্রেও মানতে হয় নির্ধারিত নিয়ম। স্কুলের বাইরে থেকেও নেই এসব বই কেনার সুযোগ।
এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে— সোনামণিরা লেখা শেখো, আধুনিক ভাষাতত্ত্ব বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা, নতুন আদর্শলিপি ও সহজ বানান শিক্ষা, হাউ টু ড্র, নিউ কালারিং ফান, সোশ্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড জেনারেল নলেজ, আমার ইসলাম শিক্ষা, মজার ছড়া, ওয়ার্ড লার্নিং ম্যাজিক, পরিবেশ পরিচিতি, লার্নিং বেসিক ইংলিশ, নিউ কারসিভ রাইটিং, দা পয়েম গার্ডেন, জুনিয়র স্কুল ডায়েরি, সোনামণিদের আনন্দ পাঠসহ নামে-বেনামে অজস্র বই।
শিশুদের মানসিক বিকাশ ও নিরাপদ শৈশব নিশ্চিত করতে পাশের দেশ ভারতেও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। সেখানে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং’ তাদের দেয়া এক সুপারিশে জানিয়েছে, প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের কাঁধে স্কুল ব্যাগে মাত্র দুটি পাঠ্যবই দেয়া যাবে। তিনটি বই দেয়া যাবে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিশুদের স্কুল ব্যাগে। শিশুদের স্কুল ব্যাগে এর চেয়ে বেশি বই দেয়া হলে স্কুল এবং অভিভাবক দু’পক্ষকেই জরিমানা এবং নোটিস পাঠানোর বিধান রাখা হয়েছে ওই সুপারিশমালায়। এদিকে শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি কিংবা অন্য যেকোনো দেশে যে সব ধরনের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায়ও বইয়ের চাপ কমিয়ে আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিকস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেন স্কুলের নিয়ম হবে ওরা স্কুলেই শিখবে; স্কুলেই পড়বে। সুতরাং বই, খাতা, পেন্সিল বা অন্যসব শিক্ষাসামগ্রী স্কুলেই থাকবে। তাদের কাঁধে এই বইয়ের বোঝা দেয়ার যুক্তি নেই। স্কুলগুলোই এসব বই সংরক্ষণ করবে এবং খেলার ছলে শিশুদের শেখাবে। বাড়িতে এসে তাদের পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে একটি বিদেশি পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে সম্পূর্ণটা সঠিকভাবে করতে করতে পারেনি।
বরং কিন্ডারগার্টেন এ বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কিন্ডারগার্টেনের সেন্স বজায় রেখে পুরো প্রক্রিয়াটি চালাতে হবে। আমাদের দেশের কিন্ডারগার্টেন প্রক্রিয়া শিশুদের জন্য অতিরিক্ত প্রেশার পড়ছে। শারীরিক এবং মানসিকভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে কিছু কিছু স্কুল ভালো করছে। তারা সব নিয়ম যথাযথভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করছে।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেনে যারা লেখাপড়া করবে তাদেরকে বইয়ের আনন্দ ও খেলাধুলার মাধ্যমে লেখাপড়া শেখাতে হবে। এসব স্কুলে পর্যাপ্ত মাঠ থাকা গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে বইয়ের চেয়ে খেলাধুলার সরঞ্জাম বেশি থাকতে হবে। উন্নত বিশ্বে সেভাবেই লেখাপড়া শেখানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা ছেলেমেয়েদের অতিরিক্ত বই এবং পড়াশোনার চাপের মুখে ফেলে দেই। এর ফলে শিশুদের সুকুমারবৃত্তি চর্চা ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারছি না। ছোটবেলা থেকে তাদেরকে একটি অসম প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিচ্ছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল সেই জায়গায় ফিরে যাওয়ার দরকার আছে। এখানে বিদেশি পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সংকটের মুখে ফেলে দিচ্ছে। একই সাথে আমাদের নিজস্ব পাঠ্যক্রমে শিক্ষা না দেয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সুতরাং শিক্ষার্থীদের বইয়ের সংখ্যা কমিয়ে খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা বাড়াতে হবে।’
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান আমার সংবাদকে বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেনগুলো এনসিটিবির নিয়ম মানছে না। এনসিটিবি আইন-২০১৮ অনুযায়ী বাংলাদেশে পরিচালিত সব স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রম এনসিটিবির নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হবে। একই সাথে যারা বিদেশি কারিকুলামে পাঠদান করছেন তাদেরও এনসিটিবির অনুমোদন নিতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই এ নিয়ম মানছে না। তবে এনসিটিবির দেখভালের দায়িত্ব থাকলেও জনবল সংকটে সব কিছু তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিন্ডারগার্টেনগুলোর অনিয়ম নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও অবগত রয়েছে। আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বই দেই তিনটি এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি অবধি ছয়টি বই দিচ্ছি। যেহেতু এই বইগুলো আমাদের শিক্ষা গবেষকদের পরামর্শ নিয়ে তৈরি করা হয় সেহেতু এর বাইরে অন্য কোনো বইয়ের প্রয়োজন নেই। এনসিটিবি এসব বই প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিশুদের বয়স এবং ধারণক্ষমতার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। তবে আমাদের কিন্ডারগার্টেনগুলো শিশুদের অযাচিত বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। একই সাথে তারা যে কারিকুলামে শিশুদের শেখাচ্ছে সেগুলোও তাদের ধারণক্ষমতার বাইরে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি।’
এনসিটিবির এই কর্মকর্তা বলেন, কিন্ডারগার্টেনগুলো নিয়ম ভঙ্গ করে বইয়ের লম্বা তালিকা ধরিয়ে দিচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ এবং অভিভাবকদের জন্য ব্যয় দুটোই বাড়ছে। কিন্ডারগার্টেনগুলো শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভর প্রক্রিয়ায় নিয়ে তাদের মেধাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ বয়সের একজন শিক্ষার্থী গান গাইবে, খেলাধুলা করবে, ছুটাছুটি করবে ও এসবের মধ্য দিয়েই শিখবে। কিন্তু আমরা এসব নিয়ম না মেনে উল্টো রথে হাঁটছি। শিক্ষার্থীদের ঠেলে দিচ্ছি অন্ধকার অসুস্থ প্রতিযোগিতার আগামীর দিকে।’