দেশে চলছে তীব্র জ্বালানি সংকট। যার ফলে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করে লোডশেডিংয়ের আওতায় নিয়ে আসে গোটা দেশ। এদিকে সারা দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিদ্যুৎখেকো অটোরিকশা। সাশ্রয়ের বিদ্যুৎ গিলে খাচ্ছে নগর ও জেলা শহরের বেপরোয়া ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক।
একদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং থেকে মুক্ত রাখতে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যাটারিচালিত রিকশায় ব্যবহূত হচ্ছে। একই সাথে সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে রাজধানী ও জেলা শহরে অবাধে চলাচল করছে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা।
এতে শুধু বিদ্যুৎ অপচয় নয়, প্রতিনিয়ত সড়কে দুর্ঘটনাও ঘটছে। ব্যাটারিচালিত তিন চাকার ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ। এ ধরনের অবৈধ যানবাহনে ছেয়ে গেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহর-বন্দর-গ্রামের হাটবাজারের অলিগলি। এসব অবৈধ যানবাহন ব্যাটারির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং সেই ব্যাটারি কয়েক ঘণ্টা পরপর চার্জ দিতে হয়।
রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, প্রতিটি রিকশা গ্যারেজেই নিষিদ্ধ এসব অটোবাইক ও রিকশার ব্যাটারি চার্জ করা হয়। সবগুলোতেই ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। অর্থের বিনিময়ে বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব অবৈধ সংযোগ দিয়ে থাকেন। ফলে বিদ্যুতের ঘাটতি বেড়েই চলছে। যেখানে জনগণের সাধারণ চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ এর ওপর বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে তিন চাকার ইজিবাইক ও অটোরিকশা। এর আগে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ জানালেও স্থায়ী কোনো সমাধান করতে পারেনি কোনো কর্তৃপক্ষই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে অবৈধ অটোরিকশা উঠিয়ে দিতে হবে। তারা বলেন, ব্যাটারিচালিত একটি অটোবাইক প্রতিদিন পাঁচ ইউনিট বিদ্যুৎ অপচয় করে।
এদিকে কোনোভাবে দমানো যাচ্ছে না বিদ্যুৎ চুরির অন্যতম প্রধান ইজিবাইক। চলমান তীব্র বিদ্যুৎ সংকটে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা জারিও করা হয়নি। দেশজুড়ে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিপত্য। হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে কিছু অসাধু ব্যক্তি ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবসা করে যাচ্ছে। ব্যাটারিচালিত সে রিকশা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজধানী ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে যাত্রী বহন করে চলছে। আর প্যাডেলচালিত রিকশার চেয়ে এর গতি বেশি হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার শিকার অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। এতে অনেক পরিবারই নিঃস্ব হচ্ছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না; বরং দিন দিন এসব যানের সংখ্যা বাড়ছেই। দেশের আট বিভাগের মহানগরীর সব শহবে একই পথে ব্যাটারির রিকশা চলাচল করায় রাজধানী শহর এই অবৈধ রিকশার দখলে চলে গেছে। দাপিয়ে বেড়ানো এসব অটোরিকশার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। খোদ রাজধানীতেই অটোরিকশার সংখ্যা দুই লক্ষাধিক। নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক বিভাগের কাছে সংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচটি উপজেলায় বর্তমানে কমপক্ষে ৫০ হাজারের বেশি অটোরিকশা চলাচল করছে। বিশেষ করে ব্যস্ত নগরী নারায়ণগঞ্জ, শিল্পাঞ্চল ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর এলাকায় এর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩০ হাজারের মতো।
পল্লী বিদ্যুৎ সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি রিকশার ব্যাটারি চার্জে এক কিলোওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ ব্যয় হয়।সেই হিসাবে আড়াই লাখ রিকশার পেছনে প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে। গরমের সময় তিন ও শীতের সময় দুই মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। বর্তমানে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেলেও এর প্রায় এক-চতুর্থাংশই ব্যয় হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশার পেছনে। রিকশাগুলোর ব্যাটারি চার্জ দেয়ার জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গ্যারেজ।
এসব গ্যারেজে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো চার্জ দেয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। গ্যারেজের মালিকরা প্রতিটি রিকশা চার্জ দেয়ার জন্য দৈনিক পাঁচ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে থাকেন। নিয়মানুযায়ী গ্যারেজগুলোতে বাণিজ্যিক মিটার থাকার কথা। কিন্তু গ্যারেজের মালিকরা বাড়ির পাশে গ্যারেজ গড়ে তুলে বাড়ির মিটারের সংযোগ থেকেই ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছেন। এতে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনে কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা নেই। যে সামান্য কয়েকটি রিকশা দেখা গেছে, সেগুলোর ব্যাটারি ও মোটর খুলে রাখা হয়েছে। রিকশা না থাকায় নগরের গলির সড়কগুলো থেকে মানুষ হেঁটে প্রধান সড়কে গিয়ে ইজিবাইক ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সমস্যা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তারপরও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করতে দেয়ার দাবি জানাননি কেউই। খুলনা সিটিতে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজারের মতো ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে বলে মনে করেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় অননুমোদিত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ উপজেলাসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় অন্তত সাত শতাধিক ওইসব যানবাহন রয়েছে। যা দৈনিক চার্জে গড়ে ব্যবহার হচ্ছে ১৫শ থেকে ১৭শ ইউনিট বিদ্যুৎ।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য মতে, যানগুলোর প্রথম সমস্যা হলো— এগুলো রিচার্জ করতে বিপুল বিদ্যুৎ খরচ হয়, আর দেশে যেখানে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে সেখানে এই যানগুলোতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার বিদ্যুতের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। অটোরিকশার মালিক সুমন বলেন, তিনি গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন অটোরিকশা চালাতে। গ্রামেও ঠিকমতো কাজ না পেয়ে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ক্রয় করেন। তার গাড়ি রাখার ব্যবস্থা না থাকায় তার মাসিক চুক্তিতে গ্যারেজে রাখতে হয়। এ জন্য তার প্রতি রিকশা মাসে চার্জসহ ১০০ টাকা দিতে হয়। ব্যাটারিচালিত এক ইজিবাইক চালক বলেন, অনেক কষ্টে একটি অটোরিকশা কেনা হয়। কেনার পর থেকে তিনি নিজেই এটি চালিয়ে আসছেন। আগে যেখানে বাড়ির ব্যবহারিক বিদ্যুৎ বিল আসতো ৩০০ টাকার মতো। কিন্তু অটোরিকশা চার্জ দেয়ায় প্রতি মাসে বিল আসছে ১৬শ থেকে ১৮শ টাকা।
গ্যারেজ মালিক মো. জাহাঙ্গীর বলেন, তার এখানে মাসিক চুক্তিতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সিএনজি ও ভ্যান গাড়ি রাখা হয়। প্রতি মাসে একটি অটোরিকশায় ১০০ টাকা ও ভ্যান গাড়ি ৫০ টাকা চার্জসহ তাকে ভাড়া দিতে হয়। চার্জ ব্যবসায় প্রতি মাসে খরচ বাদে আট থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা জানান, যে পরিমাণ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাই চলাচল করছে একেকটি অটোরিকশা ও ইজিবাইক ব্যাটারির ছয় ঘণ্টা চার্জ দিতে হয়। ছয় ঘণ্টা চার্জ দিলে গড়ে তিন ইউনিট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। দৈনিক যে পরিমাণ ওইসব যানবাহন চলাচল করছে তাকে গড়ে ১৫শ থেকে ১৭শ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকে লেগে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘আমার সংবাদকে, জ্বালানি তেলের তুলনায় বিদ্যুতচালিত গাড়িতে পরিবেশগত সমস্যা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গাড়ি এখন বিদ্যুতে চলে। এর চেয়েও বেশি ভালো হয় বিদ্যুৎচালিত গাড়ি। এতে পরিবেশের কোনো ক্ষতিই হয় না। এতে অনেক বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। তবে তার আগে আমাদেরকে নিজস্ব উৎপাদন বাড়াতে হবে।’