দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে দেশের একমাত্র সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড-ইডিসিএল। বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। বহাল তবিয়তে দুর্নীতিবাজরা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রকল্পের নামে লুটপাট, নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্য, পরিকল্পিতভাবে সরকারি ওষুধ চুরি করে বিক্রি, পদোন্নতিবাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিতে। এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের এমডির মাধ্যমে ওপর থেকে নিজ পর্যন্ত বড় অংশই এসব দুর্নীতির সাথে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, গত ৩০ সেপ্টেম্বর গেট পাস ছাড়া ঢাকা ফ্যাক্টরি থেকে ইঞ্জিনিয়ার সম্পর্কিত মান এবং প্রশাসন বিভাগের ড্রাইভার সেকশন সম্পর্কিত গাড়ির মালামাল বের করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ অক্টোবর শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও ওষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে একটি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়।
এতে বলা হয়, গত ৩০ সেপ্টেম্বর অবৈধভাবে গেট রেজিস্ট্রার খাতার এন্ট্রি ও গেটপাস ছাড়াই ঢাকা ফ্যাক্টরি থেকে ইঞ্জিনিয়ার সম্পর্কিত মান ও প্রশাসন বিভাগের অধীন ড্রাইভার সেকশন সম্পর্কিত গাড়ির মালামাল বের করে নেয়া হয়েছে। এমনকি টাকার রসিদ ছাড়াই ওই মালামালগুলো বিক্রি করে দেয়া হয়। এতে কোম্পানির কোটি কোটি টাকা ক্ষতির হয়েছে।
গেট রেজিস্ট্রার পর্যালোচনা করে দেখা যায়— ক্রমিক নং-১০৫৮ এ যে মালামাল বের করা হয়েছে; তার প্রকৃত ক্রমিক নং-১০৫৮-তে এনসিডিসি, রাজশাহী জেলার বিভিন্ন থানার তৈরি ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে।
অভিযোগে আরো বলা হয়, বিষয়টি কর্মরত শিফট ইনচার্জ মো. মোস্তাক আহমেদ, নিরাপত্তা প্রহরী মো. সোহাগ মিয়া, গাড়িচালক মো. ইউনুস আলী চৌধুরী ও মো. বিল্লাল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা বলেন, ব্যবস্থাপনা এডমিন মো. শাহবুদ্দিন খান, পিএস মো. আলী আকবর ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ টি এম আল মুইজর নির্দেশেই মালামালগুলো বের করা হয়েছে।
সংগঠনের সভাপতি কাজী ওবায়দুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই আবেদনে আরো বলা হয়, ওই কর্মকর্তারে নির্দেশেই ইতঃপূর্বে আরো অনেক মালামাল চুরি করে বিক্রি করা হয়েছে। এতে কোম্পানির কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শান্তির ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড-ইডিসিএল। এটি সরকারের একমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান; যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। দেশের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে সব সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ওই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এহসানুল কবির জগলুলের নেতৃত্বে একটি শক্তি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ডা. এহসানুল কবির জগলুলের মাধ্যমে নিয়মিতই আর্থিক দুর্নীতি, নিয়োগবাণিজ্য, টোলবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্য, পদোন্নতিবাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম করে যাচ্ছে।
এছাড়াও এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, মানিকগঞ্জ, সেফালসপরিন প্রজেক্ট, বগুড়া, গোপালগঞ্জ প্রজেক্টের নামে নানা প্রকল্প তৈরি করে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
জানা যায়, ২০১০ সালে গোপালগঞ্জ প্রজেক্টের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৫ সালে ওই প্রজেক্টে উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটি ২০১৮ সালে উদ্বোধন করা হয়। এ ছাড়া ওই প্রজেক্টে জনবল নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও ২০২১ সালে চারটি ইউনিটের মাত্র একটি ইউনিট চালু করা হয়েছে। আর বাকি তিনটি ইউনিটে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। এতে প্রকল্পটির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ওই প্রকল্পে মোট ৪০০ জন জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের পরিচালনায় ব্যয়, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ট্রান্সপোর্ট, নিরাপত্তা ব্যয়, হোল্ডিং ট্যাক্সসহ নানা খরচ ওই প্রকল্পই বহন করছে। তারপরও এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এহসানুল কবির জগলুল সুখনিদ্রায় রয়েছেন বলে মনে করেছেন অনেকেই।
গোপালগঞ্জ প্রজেক্ট ছাড়াও সেফালসপরিন প্রজেক্টের উদ্বোধন হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু উদ্বোধনের তিন বছর অতিবাহিত হলেও এখনো প্রকল্পটি চালু করা হয়নি। ইতোমধ্যে প্রকল্পটিতে জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মেশিনারিজ অব্যবহূত অবস্থায় পড়ে আছে। শুধু তাই নয়, ওইসব প্রকল্পে জনবল নিয়োগের সময়ও লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করেছেন এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এহসানুল কবির জগলুল সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
জানা যায়, গত আট বছর থেকেই আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অডিট আপত্তিও ধামাচাপা দিয়ে আসছেন এমডি এহসানুল কবির জগলুল। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার অপব্যহার করে প্রায় দুই হাজার কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছেন নিজের চেয়ারকে নিরাপদ রাখার জন্য। তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ লোকের কোনো কাজই নেই।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এহসানুল কবির জগলুলের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।