সার আমদানিতে শঙ্কা বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২২, ০১:০১ এএম

বিদেশ থেকে সার আমদানিতে জটিলতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মূলত বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের সংকটে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা সার আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে জটিলতায় ভুগছেন। তাতে বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয় সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সার আমদানির জন্য ৫১৯ কোটি (পাঁচ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার জোগানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ নিতে চিঠি দিয়েছে।

ওই চিঠিতে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতার কারণে সার আমদানি বিল পরিশোধে বিলম্ব ও এলসি খোলা জটিলতা দেখা দিয়েছে। তাতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিসিআইসি এবং বিএডিসির সঙ্গে সরবরাহকারী উদ্যোক্তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববাজারে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সারের দাম। ২০২১ সালের জুনের তুলনায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিশ্ববাজারে সারের মূল্য ১০২ শতাংশ বেড়েছে। তার মধ্যে ডিএপির মূল্য ৪৭ শতাংশ, এমওপি সার ১৭৭ শতাংশ এবং টিএসপি ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে বাড়লেও দেশে কৃষকের সারের দাম বাড়ানো হয়নি। ফলে বর্তমান এক কেজি ইউরিয়া সার ২২ টাকায় ক্রয় করছে কৃষক। তাছাড়া টিএসপি ২২ টাকা, ডিএপি, এমএপি ও এমওপি ১৬ টাকা মূল্যে দেয়া হচ্ছে। আর দাম না বাড়ানোর কারণে ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগ দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা সারের ভর্তুকি ছাড় করেছে।

সূত্র জানায়, দেশে চালসহ খাদ্যশস্য উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে এ বছর ৫৮ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন সার বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। সেজন্য ৫১৯ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। দেশীয় মুদ্রায় তার পরিমাণ ৫৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। কিন্তু ডলার সংকটে আমদানি ব্যাহত, বিল পরিশোধে বিলম্ব, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে চিঠি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

ওই চিঠিতে বলেছে, রাসায়নিক সার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কৃষি উপকরণ। সরকার এর চাহিদা অনুযায়ী সরবারহ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। সার আমদানির জন্য চলতি অর্থবছর ৫১৯ কোটি (পাঁচ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় হতে পারে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৫৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। তার মধ্যে ২০ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানি করা হবে। প্রতি মেট্রিক টনের সম্ভাব্য মূল্য ৭৫০ ডলার (এক ডলার মূল্য ১০৮ টাকা)। তাতে ইউরিয়া সার আমদানিতে সম্ভাব্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন ১৫০ কোটি ডলার। এ বছর টিএসপি সারের প্রয়োজন ৯ লাখ মেট্রিক টন। টনপ্রতি ৯০০ ডলার হিসাবে প্রয়োজন ৮১ কোটি মার্কিন ডলার। একইভাবে ডিএপি সার আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন ১৯৫ কোটি মার্কিন ডলার। এ বছর ডিএপি সার আমদানি করতে হবে ১৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। প্রতি টনের সম্ভাব্য মূল্য ধরা হয়েছে এক হাজার ডলার।

তাছাড়া এমওপি সার আমদানিতে ৯০ কোটি ২৫ লাখ ডলারের দরকার। প্রতি টনের মূল্য ধরা হয়েছে ৯৫০ ডলার। সর্বশেষ ২৫ হাজার মেট্রিক টন আমদানি করা হবে এমএপি সার। ওই খাতে বৈদেশিক মুদ্রা পৌনে তিন কোটি ডলার লাগবে। প্রতি টনের মূল্য ধরা হয়েছে ১১০০ ডলার। তবে ওই হিসাব আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য এবং ডলারের বিনিময় হারের ওপর নির্ভরশীল। ফলে আন্তর্জাতিক মূল্য এবং মুদ্রা বিনিময় হার হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে মোট ব্যয়ের অর্থের পরিমাণও কমবেশি হতে পারে।

সূত্র আরও জানায়, চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের বাজেটে সার আমদানির প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ আছে। ব্যাংকগুলোকে এখন ডলার জোগান নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সার সংকটে খাদ্য উৎপাদনে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ৩ নভেম্বর সরকারের ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে কাতার ও আরব আমিরাত থেকে ৯০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। প্রতি টন ৬২৬ ডলার হিসাবে ব্যয় হবে ৫৯৭ কোটি টাকা। তাছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয় ২৫ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি সার আমদানি করবে। তাতে ব্যয় হবে ১৪৯ কোটি টাকা। তার আগে ১৯ অক্টোবর বিএডিসির মাধ্যমে কানাডা থেকে ৫০ হাজার টন এমওপি সার এবং মরক্কো থেকে ৪০ হাজার টন সার ডিএপি আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাত কোটি ডলার।

আর ১২ অক্টোবর এক লাখ মেট্রিক টন আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। সেক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ২৮ সেপ্টেম্বর কাতার থেকে ৩০ হাজার টন ও সৌদি আরব থেকে ৩০ হাজার টন ইউরিয়া সার আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। তাতে ব্যয় ধরা হয় সাড়ে পাঁচ কোটি ডলার। ১৪ সেপ্টেম্বর কানাডা থেকে ৫০ হাজার টন মিউরেট-অব-পটাশ (এমওপি) এবং মরক্কো থেকে ৪০ হাজার টন ডিএপি সার আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। ব্যয় ধরা হয় সাত কোটি ডলার। ৩ আগস্ট সৌদি আরব থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তিন লাখ ৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। তাতে ব্যয় হবে ২০৫ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার অর্থের জোগান নিশ্চিত করা হলে ওসব অনুমোদিত সার আসতে কোনো সমস্যা হবে না।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাসময়ে আমদানি ও স্বীকৃত বিলের দায় পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। বলা হয়, যথাযথভাবে আমদানি বিল পরিশোধ না হওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে নির্ধারিত সময়ে স্বীকৃত বিলের দায় পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বৈদেশিক ব্যবসার অনুমোদন (এডি লাইসেন্স) বাতিলসহ দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম জানান, সার আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংক রেট দিয়েও অনেক বেসরকারি ব্যবসায়ী ডলার পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো ডলার দিতে চাচ্ছে না এমন অভিযোগ আসছে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে সারের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে ডলার দিতে বলা হয়েছে। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার এনে তারপর আমদানিকারকদের দিচ্ছে। ১০৭ টাকা মূল্য দিয়েও আমদানিকারকরা ডলার পাচ্ছে না। সার আমদানির ক্ষেত্রে ডলারপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।