নতুন কৌশলে মাদক ব্যবসা

খলিলুর রহমান প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২২, ০১:১২ এএম

দিন দিন নতুন কৌশল অবলম্বন করে রমরমা মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে অপরাধী চক্র। বিভিন্ন কৌশলে সীমান্ত এলাকা থেকে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক সংগ্রহ করে রাজধানীতে নিয়ে আসা হচ্ছে। সেখানে আনার পর সুন্দরী তরুণীদের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সন্দুরী তরুণীদের গ্রেপ্তার করা হলেও থেমে নেই মাদক কারবারিরা। বিশেষ করে গাঁজা, ফেন্সিডিল, ইয়াবার মতো সর্বনাশা মাদকের বেশি চাহিদা রয়েছে। এর সাথে ‘এলএসডি, ‘ক্রিস্টাল মেথ, বা ‘আইসের’ মতো মাদকের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

র‌্যাব সূত্র জানায়, চলতি বছর ফাতেমা, হালিমা, আসমাউল হুসনা নামে তিন বোনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সবজির আড়ালে ইয়াবা পাচার করত। গ্রেপ্তারের পর তিন বোনের হাতে থাকা শপিং ব্যাগে কচুর মুখির ভেতরে বিশেষ কায়দায় রাখা ১৮ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবা জব্দ করা করা হয়। জব্দকৃত ইয়াবার মূল্য ৫৬ লাখ টাকা বলে জানায় র্যাব।

র‌্যাব আরো জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা আপন তিন বোন। তাদের মধ্যে ফাতেমা মাদক কারবারি ও পাচারের মূলহোতা। তারা মোট আট ভাইবোন। সবাই ইয়াবা কারবারের সাথে জড়িত। তারা ইয়াবা পাচারের সময় ছোট শিশু সাথে রাখত, যাতে কেউ সন্দেহ না করে।

পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেন মনে করে পরিবারের সদস্যরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করছে। শুধু তাই নয়, তারা মাদক বহনে অত্যন্ত দক্ষ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমস্ত চেকপোস্ট এড়াতে একটি অন্য পথ অনুসরণ করে ইয়াবা পাচার করত। কক্সবাজার থেকে চকরিয়া পর্যন্ত আসার পর পুলিশ ও অন্যান্য চেকপোস্ট এড়াতে ফাশিয়াখালী-লামা-আলীকদম-বিলছড়ি-লোহাগাড়া পথ অনুসরণ করত।

শুধু ফাতেমা, হালিমা, আসমাউল হুসনার পরিবারই নয়, তাদের মতো হাজার হাজার তরুণী মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে কায়দা বদলে তারা রাজধানীতে ঢোকাচ্ছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য।

একাধিক পুুিলশ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, মাদক ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু পাল্লা দিয়ে চোরকারবারিরা রাজধানীতে মাদকের চালান নিয়ে আসার কৌশল বদলাচ্ছে। তাই সীমান্ত দিয়ে মাদকের চালান আসা যেন বন্ধ হয়, সে বিষয়ে কাজ করতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে মাদকসেবীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষর্থীরা মাদক সেবন করছেন। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষও নিয়মিত মাদক সেবন করছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের  মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, রাজধানী ঢাকায় কোনো মাদক তৈরি হয় না। নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে মাদক ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে আসা মাদক নিয়মিত অভিযানে জব্দ করা হচ্ছে। এ ছাড়া মাদক সেবনকারী ও কারবারিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এদিকে, মাদক কারবারিরা বিশেষ ব্যবস্থায় পায়ুপথ দিয়েও মাদক নিয়ে আসছে ঢাকায়। চলতি বছর পেটের ভেতর লুকিয়ে রাখা ৩৫০ পিস ইয়াবাসহ মাদক কারবারি মিলন গাজী ও তার সহযোগী বশির গাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর মিলন গাজি তার স্বীকারোক্তিতে জানায়, ইয়াবার চালান সে চট্টগ্রাম থেকে বিশেষ কৌশলে পেটের মধ্যে বহন করে পটুয়াখালী নিয়ে আসে বিক্রির উদ্দেশ্যে।

অপরদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, রাজধানীর ঢাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া করে মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে চক্রের সদস্যরা। এতে সুন্দর তরুণী-তরুণীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কোনো এলাকায় সুন্দর তরুণীরাও বাসা বা ফ্ল্যাট ভাড়া করে কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের কারবার। চলতি বছর এমন এক তরুণীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গ্রেপ্তারকৃত তরুণী মাদক কারবারির নাম মঞ্জিলা আক্তার ওরফে নুপুর (২৫)। নুপুর জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানা এলাকার নাকুরগাছী গ্রামের বাবু সরকারের মেয়ে। সে টঙ্গীর দত্তপাড়া ওসমান গনি রোড এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থেকে মাদক কারবার করত।

পুলিশ জানায়, নুপুর গাজীপরের পূবাইল থানায় ফেন্সিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়। সে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে মাদক কারবার চালাতেন। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ফেন্সিডিল এনে বিভিন্ন কৌশলে টঙ্গী, পূবাইল, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করত মঞ্জিলা আক্তার নুপুর।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে সুন্দরী তরুণীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠায়। আবার অনেকেই ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বন্ধুত্ব তৈরি করে। পরে সময় করে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। এক পর্যায়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ওইসব হোটেল বা স্পা সেন্টারে নিয়ে যায় টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে। সেখানে গিয়ে মাদক সেবনসহ নানা অপকর্ম করে। এসময় গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে অনেকের ছবিও তুলে রাখা হয়। তবে মাঝে মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্পা সেন্টারে অভিযানের নামে আইওয়াশ করা হলেও বিউটি পার্লার, বিভিন্ন আবাসিক ভবন, আবাসিক হোটেলে নিরাপদেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে অপরাধী চক্রের সদস্যরা।

সূত্র মতে, রাজধানীর অভিজাত ও জনবহুল এলাকায় আবাসিক ভবনে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে মাদক কারবার পরিচালনা করা হয়। বিশেষ করে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, বনশ্রী, মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকা, শ্যামলী, মিরপুর, বারিধারা, উত্তরা এলাকায় রমরমা মাদক কারবার চলছে। এসব আস্তানায় বেশির ভাগ স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা যাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে নিরাপদে মাদক সেবন ও অনৈতিক কর্মকাণেআড লিপ্ত হচ্ছেন তারা। রাজধানীতে এসব কাজে জড়িত প্রায় শতাধিক চক্র রয়েছে। একটি একটি চক্রে আট থেকে ১০ জন সদস্য রয়েছে। আর ওই চক্রের সদস্যরা নতুন নতুন কৌশলে মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কৌশলী মাদক সেবনকারী ও কারবারিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর রয়েছে।

এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত দেশে ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ ধরনের মাদকের চাহিদা বেশি রয়েছে। ভয়াবহ এসব মাদকের মধ্যে রয়েছে— ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন (টিডি জেসিক ইঞ্জেকশন), ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইঞ্জেকশন), মরফিন, আইস পিল, ভায়াগ্রা, সেনেগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) সহকারী পরিচালক মো.  মেহেদী হাসান আমার সংবাদকে বলেন, ‘মাদক কারবারি ও সেবনকারীরা কৌশল পরিবর্তন করাটাই স্বাভাবিক। তবে কৌশল পরিবর্তন করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নতুন নতুন প্রযুক্তি ও সোর্স ব্যবহার করে তাদের আইনে আওতায় আনছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম আমার সংবাদকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতির কারণে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থেকে মাদক আসছে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আরো কঠোর হতে হবে। যাতে মাদক সহজলভ্য না হয়।’

অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সন্তানদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে। তাদের সন্তানের পকেট খরচ বেড়ে যাচ্ছে না কি, বেশি রাতে বাড়ি ফেরে না কি, নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে না কি, দেরি করে ঘুম থেকে উঠে না কি— ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি নজর রাখতে হবে। পিতা-মাতাকে সন্তানের বেশি করে সঙ্গ দিতে হবে।’