হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থপাচারে হাজার হাজার এমএফএস সেবা এজেন্ট জড়িত। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে। ওসব এজেন্ট গত এক বছরে হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। অর্থ পাচারকারী চক্র বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ব্যবহার করে হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আর দিন দিন হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচারের ঘটনা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রিজার্ভ সংকট সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একটি আলোচিত ইস্যু। রিজার্ভ সংকটের সঙ্গে ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি যুক্ত। রিজার্ভ সংকটের জন্য রপ্তানি থেকে আমদানি বেশি হওয়ার পাশাপাশি দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে। আর ওই কর্মকাণ্ডে সঙ্গে হুন্ডির নাম উচ্চারিত হচ্ছে। দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স মূলত হুন্ডির মাধ্যমে ঢুকছে। ফলে সরকার একদিকে যেমন বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে যোগ হচ্ছে না। হুন্ডির দৌরাত্ম্য সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না; বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ফাঁকফোকরে দিন দিন আরো বাড়ছে।
সূত্র জানায়, সংঘবদ্ধ হুন্ডিচক্র প্রবাসে বাংলাদেশিদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা দেশে না পাঠিয়ে তার সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। অপরাধীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজটি করে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে এবং দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপ দেশীয় মুদ্রায় বৈদেশিক মুদ্রার অর্থ এমএফএস এজেন্টদের প্রদান করে আর তৃতীয় গ্রুপ বা এমএফএস এজেন্টরা বিদেশে অবস্থানকারীর নিকট থেকে প্রাপ্ত এমএফএস নম্বরে দেশীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে। ওসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা পাচারসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে।
সূত্র আরো জানায়, রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ। হুন্ডি সবসময় রিজার্ভের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অর্থনীতির ঝুঁকি মোকাবিলায় হুন্ডি কার্যক্রমের বিষয়ে সিআইডি নজরদারি শুরু করে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার এবং দেশের বাইরে অবস্থানরতদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধ করে আসছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া চার লাখ কোটি টাকার মতো। এ দেশে হুন্ডি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠার নেপথ্যে অনেকগুলো কারণ পাওয়া গেছে। হুন্ডি বিস্তার লাভের কারণগুলো দূর করা গেলে বৈধ চ্যানেলে অর্থ আসার জন্য সহায়ক হবে। সরকারের বিরাট অংকের টাকার রাজস্ব আয় হবে।
হুন্ডির সাথে বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো ও দেশ থেকে অর্থপাচার ওই দুটো বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার আনলে বা ডলার এনে ঘোষণা দিলে তা বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে যোগ হয়। কিন্তু অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ এলে তা রিজার্ভে জমা হয় না। আবার অবৈধ আয়, চাঁদাবাজি-তদবিরে আয় করা অর্থ, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সাধারণত দেশ থেকে পাচার হয়। তা ছাড়া রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি হুন্ডির মাধ্যমে সংঘটিত হয়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের জন্য দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের মানি এক্সচেঞ্জ, বিদেশি ব্যাংক ও হুন্ডির রেট ভিন্ন ভিন্ন। ব্যাংকের বিনিময় হারের তুলনায় হুন্ডিতে ভালো বিনিময় মূল্য পায় বলেই প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে আগ্রহী হয়। এমনকি সরকার ঘোষিত প্রণোদনার পরও হুন্ডিতে অনেক বেশি বিনিময় মূল্য পায় প্রবাসীরা। সে জন্যই ব্যাংকের বদলে হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন তারা।
তা ছাড়া সরকার কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে রপ্তানি আয় দেশে ফেরা মাত্রই অগ্রিম আয়কর বা এআইটি কেটে রাখে। ফলে ব্যবসায়ীরা রপ্তানি আয়ের একটি অংশ বিদেশে রাখতে কিংবা পরবর্তী আমদানির জন্য ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা না ভাঙানোর ঝোঁক দেখায়। অভিযোগ আছে, এআইটি থেকে বাঁচতে ব্যবসায়ীরা বিদেশি ক্রেতাদের যোগসাজশে রপ্তানির এলসি মূল্যমান কম দেখিয়ে বাকি টাকাটা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আনে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এমএফসের মাধ্যমে হুন্ডি করে এমন পাঁচ হাজারের বেশি এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে তারা এমএফএস সেবা বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ব্যবহার করে হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।