রাজধানীর রাজপথ দখল করে নিচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা। প্রতিটি সড়ক ও মহাসড়ক যেন একেকটি টার্মিনাল। স্থায়ী বাস টার্মিনাল থাকার পরও আন্তঃশহর ও দূরপাল্লার বাসগুলো মহাসড়ক ও সড়কের দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হচ্ছে। এতে তীব্র যানজট ও জনসাধারণের চলাচলে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
জানা যায়, রাজধানীর আরামবাগ থেকে কমলাপুর যাওয়ার মেইন রাস্তায় বাস রাখা হয়। গতকাল ওই রাস্তায় আয়াত, বিআরটিএ পরিবহনের কয়েকটি বাস রাখতে দেখা গেছে। রমজান নামের এক চা-দোকানি আমার সংবাদকে বলেন, ‘ওই রাস্তায় নিয়মিতই বাস রাখা হয়। রাত ৮টার পর থেকে বাসগুলো সারিবদ্ধ করে রাখা হয়। সকাল হলে সেখান থেকে বাসাগুলো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছেড়ে যায়।
এছাড়া আরামবাগ থেকে কমলাপুর যাওয়ার ডান পাশে ফুটপাতে পলিথিন দিয়ে তাঁবু বানিয়ে গৃহহীন মানুষ বসবাস করে। তবে সেখানে রাতভর মাদক ক্রয়-বিক্রয় করা হয়।’ শুধু তাই নয়, সারিবদ্ধ বাসগুলোর আড়ালে মাদক সেবন করা হয় বলেও জানিয়েছেন ওই ব্যবসায়ী।
কমলাপুর মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, আয়াত বাসের একটি কাউন্টার। সেখান থেকে আয়াত পরিবহনের বাসগুলো ছেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও ৬ নম্বরের কয়েকটি বাস সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আরামবাগ মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, ফুটওভারব্রিজের নিচে কয়েকটি বাসা রাখা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বাসগুলো সেখান থেকে মতলব, মুন্সিরহাট ছেড়ে যায়। ফুটওভারব্রিজ থেকে কয়েকশ গজ দূরে অনেকগুলো বাস কাউন্টার রয়েছে। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাস ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। এছাড়া মতিঝিল শাপলা চত্বরে ফুটওভারব্রিজের নিচেও একই অবস্থা দেখা গেছে। সেখানে কয়েকটি বাস সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে।
এদিকে, একই রাতে ফকিরাপুল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তার দু’পাশেই দূরপাল্লার অনেকগুলো বাস রাখা হয়েছে। সেখান থেকে বাসগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যায়। তবে দিনের বেলা মিনিবাসে করে যাত্রী পরিবহন করা হলেও রাতের বেলাবাসগুলো সেখানে রাখা হয়। এতে ওই এলাকায় রাতেও যানজটের সৃষ্টি হয় বলে জানা গেছে। শুধু তাই মূল সড়কে বাসস্ট্যান্ড হওয়াতে সেই এলাকার ফুটপাত ও রাস্তার অনেকগুলো দোকান বসানো হয়েছে। ওইসব দোকানের কারণেও মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এদিকে, সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাসটার্মিনালের মাত্র কয়ে গজ দূরে মহাসড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে বিকল্প আরেক টার্মিনাল। কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম থেকে গোপীবাগ-মানিকনগর হয়ে একেবারে গোলাপবাগ পর্যন্ত মহাসড়কের উপর থেকে দূরপাল্লার বাস ছাড়ে। ঢাকার বাইরে থেকেও যাত্রীরা এসে মহাসড়কের উপরই নামে। দিনের বেলা মহাসড়কে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েকটি কোম্পানির দূরপাল্লার বাস। এতে করে ওই সড়কে রাত-দিন যানজট লেগেই থাকে। চোখের সামনেই সড়ক দখল করে বাস টার্মিনাল গড়ে উঠলেও তা যেন দেখার কেউ নেই। পুলিশও রহস্যজনক কারণে নীরব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সায়েদাবাদ টার্মিনাল বাস মালিক সমিতির এক নেতা আমার সংবাদকে বলেন, ‘পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা তথা রাস্তার শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে রাস্তার উপর থেকে বাস কাউন্টারগুলো সরাতে হবে। এ জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে টার্মিনালের বাইরে এভাবে টার্মিনাল বন্ধের দায়িত্ব পুলিশের বলেও জানান ওই পরিবহন নেতা।
অপরদিকে রাজধানীর আজিমপুর এলাকায় একই চিত্র দেখা গেছে। ওই এলাকায় আন্তঃশহর বাসগুলো স্থায়ীভাবে এতিমখানা মোড় থেকে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত দিন-রাত সড়ক দখল করে রাখে। এতে সড়কে যানজট বাড়ে, স্কুলগামী শিশুদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
এছাড়া পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এই গুরত্বপূর্ণ সড়কটি নিয়মিত পরিষ্কার করতে পারছেন না, গভীর রাতে নেশা সেবনকারীদের আনাগোনা বাড়ে। পথচারীরা ছিনতাইসহ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হন অহরহ। এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
জানা যায়, গুলিস্তান ফুলবাড়ীয়া বাসটার্মিনাল থেকে যেসব বাস ছাড়ে সেগুলোর বেশির ভাগই আজিমপুরে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়ায়। সে কারণে আজিমপুরে অস্থায়ী একটি বাসটার্মিনালের সৃষ্টি হয়েছে। যাতে করে ওই এলাকায় যানজট মানুষের নিত্যসঙ্গী।
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২৬ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হাসিবুর রহমান মানিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘আজিমপুর এলাকায় দীর্ঘ দিনের সমস্যা অস্থায়ী বাসটার্মিনাল। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় ওই এলাকায় মূলসড়ক দখল করে বাস রাখা হয়। এতে দিনে বেলা তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এসময় স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হন।’ এ ছাড়া রাতের আঁধারে সেই এলাকায় নানা ধরনের অপকর্ম চলে বলেও জানান ওই জনপ্রতিনিধি।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রাস্তায় বাস রাখার কারণে রাতে ওই এলাকায় চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। শুধু তাই নয়, অনেক সময় বাসগুলোর মধ্যে দেহব্যবসা হয় বলেও জানান ওই কাউন্সিলর।
শুধু আজিমপুর, মতিঝিল, আরামবাগ, মানিকগর, কমলাপুর নয়— একই চিত্র রাজধানী অভিজাত এলাকা উত্তরাতেও। উত্তরার আব্দুল্লাহপুর ও আজমপুরে রয়েছে বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার বাসের কাউন্টার। মহাখালী টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া সবগুলো রুটের বাসই উত্তরার আব্দুল্লাহপুর ও আজমপুরে দাঁড়ায়। এ জন্য সেখানে রয়েছে বাসকাউন্টার। এর বাইরেও শুধু উত্তরা থেকে কিছু বাস ছাড়ে যেগুলোর শুরু ও গন্তব্য উত্তরা এলাকাতেই। দূরপাল্লার ওই বাসগুলো মহাখালী টার্মিনাল পর্যন্ত আসে না।
এসব ছাড়াও গোটা রাজধানীর প্রতিটি এলাকার সড়ক দখল করে বড় ও মিনিবাস দাঁড়ানো থাকে। মিরপুর ১ নং সেকশন থেকে দুই নম্বর হয়ে একেবারে ১০ নং গোলচত্বর পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে শত শত বাস দাঁড়ানো থাকে। কালশী, পুরবী থেকে মিরপুর ১২ পর্যন্ত মূল রাস্তা দখল করে বাস রাখা হয়। সে কারণে ওই সব এলাকাও নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়। রাতের আঁধারে ছিনতাইকারী ও মাদক কারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। বাসগুলোর আড়ালে মাদকসেবীরা নিরাপদেই মাদক সেবন করে।
তবে পরিবহন শ্রমিকরা জানান, রাস্তা দখল করে বাস বা যেকোনো গাড়ি রাখার জন্য পুলিশকে টাকা দিতে হয়। এমনকি ফ্লাইওভারের নিচে গাড়ি রাখার জন্যও পুলিশকে টাকা দিতে হয়। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাসস্টপেজ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তবে এসব স্টপেজে বাস না থামালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। নিদের্শনা না মেনে কেউ রাস্তায় বাস রাখলে তাদের বিরুদ্ধেও আইন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মূল কারণ অস্থায়ী বাসটার্মিনাল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সচেতন হতে বলা হয়। কিন্তু রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে অবৈভাবে বাসটার্মিনাল করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের দোকান বসানো হয়েছে। এতে জনসাধারণ সড়কের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হয়। দিন দিন সড়ক সংকুচিত হচ্ছে। তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এটা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে যুগোপযোগী উদ্যাগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ আমার সংবাদকে বলেন, ঢাকায় টার্মিনাল সংকট রয়েছে। এ কারণে বাসগুলো রাস্তায় রাখা হয়। তবে টার্মিনাল সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে আর বাসগুলো রাস্তায় রাখা হবে না বলেও জানান তিনি।