মূল্যবৃদ্ধিতে বাড়বে অসন্তোষ

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২২, ১২:২৮ এএম

গ্যাস-বিদ্যুতের স্বাভাবিক সরবরাহ নেই। ভোগান্তিতে নাকাল নাগরিক জীবন। উদ্যোক্তারা মারাত্মক হুমকির মুখে। বাসাবাড়িতে রান্নাকাজে দুর্ভোগ পোহাতে হয় গৃহিণীদের। এর মধ্যেই বেড়েছে বিদ্যুতের পাইকারি দাম। এবার বাড়বে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। বাড়বে গ্যাসের দামও। ফলে আরেক দফা বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম।

এদিকে বাসাবাড়িতে নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ না থাকলেও গুনতে হয় পুরো মাসের বিল। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িতে গ্যাসের আকাল চলছে।

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা রাজন করিম আমার সংবাদকে বলেন, আবাসিকে দুই চুলার গ্যাসের দাম এক হাজার ৮০ টাকা ও এক চুলার গ্যাসের দাম ৯৯০ টাকা। গত দুই মাস পরিবারের বিভিন্ন কাজে গ্রামে থাকতে হয়েছে। তাতেও আমাকে গুনতে হয়েছে দুই মাসের জন্য দুই হাজার ৬০ টাকা। অথচ এই টাকার এক টাকাও আমার কোনো কাজে আসেনি।

গ্যাসের সংকটে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় দিনে জ্বলছে না রান্নার চুলা। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক পাওয়া যাচ্ছে। ফলে অনেকেই এখন পাইপলাইনের গ্যাসের পাশাপাশি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। এতে পরিবারের খরচ বেড়েছে। তবে ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।

এর পরও দাম বাড়ানো হলে চরম দুর্ভোগে পড়বে সাধারণ মানুষ। পাল্লা দিয়ে বাড়বে নিত্যপণ্যের দামও। এ যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অনেকে ছাড়তে শুরু করেছেন রাজধানী ঢাকা। আবার অনেকে পরিবার পরিজনকে রেখে আসছেন গ্রামে। অনেকে বা খুঁজছেন সাবলেট বাসা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী জানুয়ারি নাগাদ রাজধানী ছাড়বে ১০ লাখ মানুষ।

রাজধানীর শনির আখড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, প্রায় এক যুগ ধরে স্ত্রী-সন্তানসহ ঢাকায় বসবাস করছি। এতদিন ভালোই ছিলাম; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই শহরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়লে শহরে আর থাকা সম্ভব হবে না। জুরাইনের ভাড়াটিয়া রাজিন মিয়া বলেন, শহরের জীবন মান এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। গত মাসে তিন রুমের ফ্ল্যাট বাসা রেখে সাবলেট বাসায় উঠেছি। সব কিছুর দাম বাড়লেও আমার মতো মধ্যবিত্তের আয় বাড়েনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ঠিকমতো নিত্যপ্রয়োজনীয় গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। এর মধ্যেও দাম বাড়ানো হবে বিবেকহীন কাজ। সাধারণ জনগণের ওপর এটি জুলুম হয়ে যাবে। রাজধানীর অনেক ভবনে পাইপলাইন গ্যাস সংযোগ দেয়া। এগুলোতে দোকান বা বিভিন্ন কোম্পানির অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ব্যবহার করা হয় না গ্যাস। তবুও বিল গুনতে হয় ফি মাস। তারা বলছেন, গ্যাস খরচ না করেও বিল নেয়াটা অন্যায়। এই সিস্টেম থেকে বের হয়ে আসা উচিত। এতে ভোক্তার অধিকার খর্ব করা হয়।

এদিকে জ্বালনির দাম বৃদ্ধি করতে তড়িগড়ি করছে সরকার। ইতোমধ্যে গ্রাহকদের মনে এ রকম একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা)

একটি সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এক সময় সর্বোচ্চ ৩২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। এক মাস  আগেও ৩০০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত দিনে সরবরাহ করা হয়েছে। এক মাস ধরে দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ৪৮ কোটি ঘনফুট।

দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা; কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি কমানো হয়েছে। সরকার গত জুলাইয়ে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে গ্যাস-সংকট দেখা দিয়েছে।

তিতাসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা অনুসারে গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। গ্রাহকরা নিয়মিত অভিযোগ করছেন। কিন্তু তারা কোনো সমাধান দিতে পারছেন না। দিনে তাদের গ্যাসের চাহিদা ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি ঘনফুট; কিন্তু এখন তারা পাচ্ছেন ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) এখতিয়ার ক্ষুণ্ন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সরাসরি নির্ধারণের ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার।

এর আগে জ্বালানির দাম বাড়ানোর একমাত্র এখতিয়ার ছিল বিইআরসির। এখন দ্রুত আইন সংশোধন করে সরকার ক্ষমতা নিয়ে নেয়াতে কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য বিইআরসি আইনের সংশোধন মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে সংশোধনী কার্যকর করা হবে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে। এতে করে সরকার যেকোনো পরিস্থিতিতে জ্বালানির দাম বাড়াতে পারবে। আইএমএফের শর্ত বা পরামর্শ অনুযায়ী স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। সে জন্য আইন সংশোধনে তাড়াহুড়ো করছে সরকার। সংসদে এ আইন পাস করতে হলে কিছুটা সময় বেশি লাগবে। এ জন্য রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এটি কার্যকর করতে চায় সরকার।

সূত্র বলছে, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বহু কাঙ্ক্ষিত আইএমএফের প্রথম কিস্তির ঋণের অর্থ পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। এর আগে আইএমএফের বোর্ড সভায় এ ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন হতে হবে। তার আগেই আইএমএফের শর্ত বা করণীয় পালনের অংশ হিসেবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণে অনেকটা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-অপচয়গুলো চিহ্নিত করা যেত। নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ সব কিছু মানা হবে না। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে। তাদের মতে, বিভিন্ন বিষয়ে শুনানি ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় বলে বিইআরসির ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হচ্ছে।

কারণ সরকার চাইলে বিধি সংশোধন করে বিশেষ বিইআরসির মাধ্যমেই কম সময়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করতে পারত। আইন সংশোধন করে ক্ষমতা খর্বের প্রয়োজন ছিল না। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বিইআরসির মাধ্যমে দাম সমন্বয় করতে কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগে। কমিশন যেসব কাগজপত্র চায়, তা তৈরি ও অডিট করতেও সময় যায়; কিন্তু বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য দ্রুত ওঠানামা করে। বিশেষ সময়ে চাইলেও দ্রুত দাম সমন্বয় করা যায় না। তাই আইনে সংশোধনী এনে কিছু ক্ষমতা সরকার তার হাতে রাখল।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, ‘আইন সংশোধন করার ফলে ভোক্তা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে। গ্যাস-বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আরও কমবে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের প্রস্তাবনা অনুসারেই বিইআরসি গঠন করা হয়েছিল। সংস্থাগুলো ১৯৯৬ সাল থেকে এ বিষয়ে চাপ দিয়ে আসছিল। পরে ২০০৭ সালে কমিশন কার্যকর হয়। গত এক যুগের বেশি সময় ধরে বিইআরসি চমৎকার কাজ করে যাচ্ছে। গ্রাহক, ভোক্তাদের কথা বলার জায়গা ছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জবাবদিহির আওতায় এসেছিল অনেকটা।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, ‘জনগণকে ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি করে দিচ্ছে সরকার। এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়ার কাছে এ অঞ্চলের মানুষ জিম্মি ছিল। এখনো ভোক্তারা ব্যবসায়ীদের কাছে এমনিভাবে জিম্মি।’ বেসরকারিভাবে জ্বালানি আমদানি করার মধ্যে ভালো কিছু্ই নেই। সরকারের জ্বালানি নীতির অভিজ্ঞতা থেকে মনে করছি, জাতীয় সক্ষমতা বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে এমন আমদানিনির্ভরতার কারণে।

প্রথমত, সরকার জ্বালানি খাতের আমদানিনির্ভরতা বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকার এখন বেসরকারি খাতে দিয়ে দিচ্ছে। এদিকে পাইকারি (বাল্ক) বিদ্যুৎ বিক্রিতে ডিমান্ড চার্জ চায় পিডিবি। খুচরা বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে ডিমান্ড চার্জ পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ কোনো গ্রাহক একবার বিদ্যুৎ সংযোগ নিলেই তিনি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন আর নাই করেন— ডিমান্ড চার্জ পরিশোধ করতেই হয়। এই চার্জকে ফিক্সড বা স্থায়ী চার্জও বলা হয়; কিন্তু বাল্ক বা পাইকারি বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবিকে এই চার্জ পরিশোধ করতে হয় না; কিন্তু পিডিবি বলছে, এখন থেকে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে ডিমান্ড চার্জ পরিশোধ করতে হবে।’ আইন অনুযায়ী, দেশে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার পুরোটাই কিনে নেয় পিডিবি। সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের একক ক্রেতা পিডিবি। এরপর পিডিবি সেই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করে। বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রির দাম ঠিক করে দেয় বিইআরসি। একই সাথে বিইআরসি খুচরা বিদ্যুতের দামও ঠিক করে দেয়।

সর্বশেষ ডিমান্ড চার্জ নির্ধারনণকরা হয় ২০২০ সালে। তখন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সময় আবাসিকে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের জন্য ৩০ টাকা করে ডিমান্ড চার্জ নির্ধারণ করে দেয় কমিশন। তবে আবাসিকে গৃহ নির্মাণের জন্য সংযোগ নিলে ডিমান্ড চার্জ প্রতি কিলোওয়াটে ১০০ টাকা।

অন্যদিকে শিল্প এবং বাণিজ্যিক সংযোগে প্রতি কিলোওয়াটে ডিমান্ড চার্জ ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানেও কোনো অস্থায়ী সংযোগে ডিমান্ড চার্জ ১০০ টাকা ধরা রয়েছে। সেহেতু বর্তমান আইনে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেলের মূল্য সমন্বয়ে সরকারের ক্ষমতা সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিধান সংযোজনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করা যেতে পারে।