রণক্ষেত্র নয়াপল্টন। সংঘর্ষ পুলিশ-বিএনপির। টিয়ারশেলের আঘাতে মকবুল নামে একজন নিহত হয়েছেন বলে দাবি বিএনপির। বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন জানিয়েছে দলটি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, আব্দুস সালাম, খায়রুল কবির খোকন, আমানুল্লাহ আমানসহ শতাধিক নেতা আটক।
প্রতিবাদে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সোয়া ৫টা থেকে মাটিতে বসে পড়েন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাত ৮টা এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তখনো বিএনপি কার্যালয় ঘিরে রেখেছে পুলিশ।
সরেজমিন দেখা যায়, ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতারা দুপুর ১টার দিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে বসে পড়েন। দিতে থাকেন সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান। এক পর্যায়ে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়— আগামী ১০ তারিখ পর্যন্ত তাদের এই অবস্থান চলবে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ফকিরাপুল কাকরাইল এলাকায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, দুপুর ২টার দিকে কয়েক হাজার পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে রায়টকার দিয়ে মুহুর্মুহু টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পল্টন এলাকায়। এক পর্যায়ে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ। দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলে প্রায় তিন ঘণ্টা। সাড়ে ৪টার দিকে বিএনপির কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে অভিযান চালায় পুলিশ।
এসময় মির্জা ফখরুল বলেন, পুলিশ ভেতরে বোমা জাতীয় কিছু রেখে এর দায় আমাদের ওপর চাপাবে এটি আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে। গুলিবিদ্ধ ও দলীয় কার্যালয়ে অভিযানের ঘটনায় আজ বৃহস্পতিবার বেলায় ৩টায় গুলশানে সংবাদ করবে বিএনপি।
বিএনপি কার্যালয়ে পুলিশ : শেষবেলায় বিএনপির কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকল পুলিশ। এক পর্যায়ে নেতাকর্মীদের পেটাতে পেটাতে বের করে নিয়ে আসে। গতকাল বিকেল সোয়া ৪টার দিকে পুলিশের একটি দল বিএনপির কার্যালয়ে বিশাল দল নিয়ে ঢুকে। এরপরই কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই সময় প্রায় অর্ধশত নেতা ভেতরে গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাত্ত ছিলেন বলে দলটির দপ্তর থেকে জানানো হয়।
রিজভী, আমান, সালাম, এ্যানী ও শিমুল বিশ্বাসসহ শতাধিক আটক : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে আটক করা হয়। এ ছাড়া বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানুল্লাহ আমানসহ শতাধিক নেতাকে আটক করা হয়।
মকবুল নিহত : বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন বলে জানায় দলটি। নিহত ব্যক্তির নাম মকবুল আহমেদ। তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, মরদেহ মর্গে রাখা হয়েছে। ‘নিহতের শরীরে শটগানের গুলির আঘাত রয়েছে।’ হাসপাতাল সূত্র জানায়, বেলা সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নয়াপল্টনের সংঘর্ষে আহত আটজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে আনা হয়। তাদের মধ্যে মকবুল মারা গেছেন। অন্যদের মধ্যে চারজনের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন— রনি, মনির, আনোয়ার ইকবাল ও খোকন।
এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় ২১ জনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন মো. রবিন খান, মো. আনোয়ার ইকবাল (বোরহান উদ্দিন কলেজ ছাত্রদল), মো. খোকন, মো. মনির হোসেন, মো রাশেদ (পল্টন থানা যুবদল), মো. ইয়াসির আরাফাত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল, জসীমউদ্দীন হল), মো. সুমন (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদল), মো. জহির হাসান (ছাত্রদল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়), মো. শামীম (রূপনগর থানা স্বেচ্ছাসেবক দল), মো হানিফ, মো. হূদয় (কদমতলী থানা স্বেচ্ছাসেবক দল), মো. মকবুল হোসেন (কদমতলী থানা স্বেচ্ছাসেবক দল), মো. ফারহান আরিফ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুজিব হলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক), মো. নূরনবী (শাহবাগ থানা যুবদল), মো. সুলতান আহমেদ (শাহ আলী থানা যুবদল), মনির (শাহবাগ থানা যুবদল), মো. আমিনুল ইসলাম (শেরেবাংলা নগর থানা যুবদল), মো. আশরাফুল ইসলাম (গুলশান থানা ছাত্রদল), বিপ্লব হাওলাদার (ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল), মো. আসাদুজ্জামান (ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল), মো. মেহেদী হাসান নয়ন (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদল)।
বিএনপি কার্যালয়ের সামনে বসে গেলেন ফখরুল : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে মাটিতে বসে গেছেন। গতকাল বিকেল ৪.৫০টার সময় তিনি বসে যান। এর আগে বিকেল ৪.২০-এ পুলিশ যখন তালা ভেঙে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে ওই সময় তিনি ঘটনাস্থলে আসেন। আধাঘণ্টা পর্যন্ত কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করেন কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। একপর্যায়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কবির রিজভী, শিমুল বিশ্বাস ও শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীকে আটকের দৃশ্য দেখে ওখানেই বসে পড়েন তিনি।
এ সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একটা ভয়াবহ, ভীতিকর ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা আশা করতে পারি না, একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের সামনে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তিনি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং অবিলম্বে সেখান থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের দাবি জানান। মির্জা ফখরুল বলেন, অন্যথায় সব দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করেই তো এগুলো হচ্ছে। তারা সমাবেশকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ‘আমাকে আমার কার্যালয়ে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ পুলিশ, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের লোকজন ঢুকছে, বের হচ্ছে। আমরা সন্দেহ করছি, তারা ভেতরে বোমা জাতীয় কিছু রেখে এর দায় আমাদের ওপর চাপাবে।
দুপুর ১টা থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান : তিন দিন আগেই নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে অবস্থান নেয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। গতকাল দুপুর ১টায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গাড়িতে দুটো অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে বসে পড়েন তারা। সরেজমিন দেখায় যায়, গতকাল সকাল থেকেই বিএনপির কার্যালয়ের সামনে শতশত নেতাকর্মী অবস্থান করেন। দুপুর ১২টার দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপর সাড়ে ১২টার দিকে দুটো ট্রাক আসে। তাতে মাইক ব্যানারসহ অস্থায়ী মঞ্চ দেখা যায়। এক পর্যায়ে মাইক্রোফোন ঘোষণা দেয়া নেতাকর্মীদের রাস্তায় বসে পড়তে দেখা যায়। মুহূর্তে কয়েক হাজার নেতাকর্মী রাস্তায় বসে পড়লে ফকিরাপুল থেকে কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও দূরে গিয়ে অবস্থান করে। দুপুর দেড়টায় মাইক এ ঘোষণা দেয়া হয়— সড়কের এই অবস্থান চলমান থাকবে আগামী ১০ তারিখ পর্যন্ত।
বোমা রাখার খবর পেয়ে বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান —ডিএমপি কমিশনার : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, বিএনপি কার্যালয় থেকে বেশ কিছু ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। তারা দলীয় কার্যালয়ে চাল, ডাল, খাবার-দাবার জমা করেছে বলে শুনেছি। তারা চাল-ডালের বস্তার মধ্যে ককটেল নিয়ে রেখেছে। আমরা সেখানে নাশকতাবিরোধী অভিযান চালিয়েছি, বলেন তিনি। নয়াপল্টনে পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার এ কথা বলেন। ১০ ডিসেম্বর বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমরা তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমোদন দিয়েছি। তারা হয় সোহরাওয়ার্দীতে যাবে, মিরপুর কালশী আছে, ইজতেমা মাঠে যেতে পারে, পূর্বাচল বাণিজ্য মেলার মাঠে যেতে পারে। ১০ লাখ লোক নিয়ে পল্টনে সমাবেশ করার কোনো জায়গা নেই। জনদুর্ভোগের দায়িত্ব এবং জননিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত হয়, তার দায়িত্ব নিতে আমরা রাজি না।