গত ১৩ নভেম্বর থেকে ই-টিকিটে চলছে রাজধানীর মিরপুর অঞ্চলের ৩০ কোম্পানির বাস। তবে এ সেবা ও ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দূরত্বভেদে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ নগরবাসীর। কাউন্টার উঠিয়ে স্ট্যান্ডবাই বা বাসে পজ মেশিনে টিকিট দেয়া হচ্ছে যাত্রীদের। কেউ কেউ এ ই-টিকিট সেবাকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার কেউ ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
এদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পর্যবেক্ষণেও এ সেবায় যাত্রী-মালিক-শ্রমিকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, পরিবহন খাতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি এই খাতের আমূল সংস্কার করা না গেলে ই-টিকিটিং সিস্টেমে সিটি বাস সার্ভিস ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সবার মাঝেই নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ-সরকারকে যথোপযুক্ত উদ্যোগ নিতে হবে।
সর্বশেষ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, শুরুতেই ই-টিকিটিং নিয়ে যাত্রী, বাস মালিক-শ্রমিকের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পরে ই-টিকিটিং চালুর পর বিভিন্ন রুটে মালিকরা বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেন। ই-টিকিটিংয়ে চলাচলকারী বাসে দূরত্বের ব্যবধানে স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেন নগরীর যাত্রী সাধারণ।
যেমন— রামপুরা থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার আগে এই পথে ভাড়া ছিল ২০ টাকা, ই-টিকিটে এই পথের ভাড়া আদায় হচ্ছে ২৫ টাকা। অথচ আট কিলোমিটার এই পথে ২০ টাকা ভাড়া আদায় হওয়ার কথা। খিলক্ষেত থেকে মিরপুর-২ আগে ১৫ টাকা ভাড়া আদায় হলেও ই-টিকিট চালুর পর ২০ টাকা নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে কোনো কোনো পথে ভাড়া কমে আসার নজিরও রয়েছে। যেমন খিলক্ষেত থেকে মিরপুর-১১ পথে নিয়মিত যাত্রী রাকিবুল হাসান আগে এই পথে ৩০ টাকায় যাতায়াত করলেও ই-টিকিটিং চালুর পর থেকে নিয়মিত ২২ টাকা ভাড়ায় যাতায়াত করছেন। আসাদগেট থেকে মিরপুর-১ আগে ২৫ টাকা ভাড়া নেয়া হলেও ই-টিকিটিংয়ে এ পথের ভাড়া ১৩ টাকায় নেমে আসে। শেওড়াপাড়া থেকে ধানমন্ডি-২৭ পর্যন্ত আগে ২০ টাকা ভাড়া নেয়া হলেও ই-টিকিটিংয়ে এ পথের ভাড়া ১৩ টাকায় নেমে আসে। রামপুরা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত আগে ২০ টাকা ভাড়া আদায় করা হলেও ই-টিকিটিংয়ে নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। মিরপুর-১ থেকে গাবতলী আগে ভাড়া ছিল ২০ টাকা, ই-টিকিটিংয়ে নেয়া হচ্ছে ১০ টাকা। মিরপুর-১ থেকে সাভার আগের ভাড়া ৪০ টাকা হলেও ই-টিকিটিংয়ে ৩০ টাকায় নেমে আসার চিত্র উঠে এসেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, মিরপুরগামী সব পরিবহনে এখনো ই-টিকিট পদ্ধতি চালু হয়নি। তবে যেসব বাসে এ সেবা চালু রয়েছে, সেসব গাড়িতে কিলো হিসেবে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না। প্রায় সবকটিতে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে। গত বুধবার বসুন্ধরা, সদরঘাট মিরপুর এলাকা ঘুরে এর সত্যতা মিলেছে।
এদিকে বসুন্ধরা যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে নূরে মক্কা পরিবহনে করে কালশী মোড় যান গাজী সাদেক। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ই-টিকিট চালু হওয়ায় আমরা খুশি। তবে সরকার নির্ধারিত কিলোপ্রতি হিসেবে ভাড়া নেয়া হচ্ছে না। কারণ বসুন্ধরা যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে কালশী মোড় পর্যন্ত মোট ছয় কিলোমিটার। কিলো হিসেবে ভাড়া আসে প্রায় ১৪ টাকা। অথচ ই-টিকিটে নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। এভাবে অতিরিক্ত ভাড়া নিলে তো আমাদের জন্য কষ্ট হয়ে যাবে। পরিবহনসহ সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে গত ২৪ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে আধুনিক গণপরিবহন সেবায় ই-টিকিটিং ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতারা বলেছেন, পরিবহন খাতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি এই খাতের আমূল সংস্কার করা না গেলে ই-টিকিটিং সিস্টেমে সিটি বাস সার্ভিস ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ ই-টিকিটে দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া আদায় নিশ্চিত করায় যাত্রীভাড়া কমে আসছে। ফলে বাস মালিকের আয়ও কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বাসে কোম্পানির জিপি ও অদৃশ্য খাতের রুট খরচ বন্ধ করা না গেলে অনেক পরিবহন মালিককে লোকসান দিয়ে বাস চালাতে হবে। যানজট, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ সিটি সার্ভিসের বাস খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে না।
যাত্রীদের কেউ কেউ ই-টিকিট সেবাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, চার্টে প্রদর্শিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় হচ্ছে। পাশাপাশি যে টিকিট দেয়া হচ্ছে তাতে উঠা-নামার স্থান লেখা থাকে না। এ সেবায় কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরেছে। তবে তথ্যসম্বলিত একটি পরিপূর্ণ টিকিট দেয়া হচ্ছে না। আবার অনেক সময় সরাসরি ভাড়া আদায়ও হচ্ছে অভিযোগ তাদের। তবে সরেজমিন কয়েকটি বাসের ই-টিকিটে উঠা-নামার স্থান লিখা রয়েছে। বেশির ভাগ বাসের ই-টিকিটে লেখা নেই।
সদরঘাট থেকে মিরপুর যাবেন এমন কয়েকজন যাত্রী প্রতিবেদককে বলেন, ই-টিকিট চালুতে আমরা খুশি। তবে ভাড়া বেশি নিচ্ছে। দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া আদায় হচ্ছে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ই-টিকিট দিয়ে কোথাও কোথাও বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তবে দূরত্ব অনুযায়ী সঠিক ভাড়া আদায় হচ্ছে না। আমাদের দাবির প্রেক্ষিতেই ই-টিকিট সেবা চালু করেছে মালিকপক্ষ। এ নিয়েও যাত্রী-মালিকপক্ষের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে টিকিট দেয়া মানে সেবামূল্যের রসিদ থাকা। আন্তর্জাতিক ক্রেতা ভোক্ত অধিকার আইন অনুযায়ী প্রতিটি পণ্যের রসিদ প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতিটি টিকিটে টিকিট প্রদানকারী বাসের নাম, বাসের নিবন্ধন নম্বর, যাত্রা ও গন্তব্যের নাম, দূরত্ব, ভাড়ার অঙ্ক, ভ্রমণ তারিখ ও অভিযোগ কেন্দ্রের নম্বরগুলো থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে প্রদত্ত ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় এসবের পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। কোনো কোনো টিকিটে শুধু ভাড়ার অঙ্ক লেখা রয়েছে। যাত্রা ও গন্তব্যের নাম, বাসের নাম ও নম্বর নেই, ফলে এসব টিকিট দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলে যাত্রীদের প্রতিকার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা জেনেছি, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের ভেতর ঢাকার সব বাসে ই-টিকিট সেবা চালু করা হবে।
তাই মালিকপক্ষকে সঠিক পন্থা অবলম্বনের আহ্বান জানাই। পাশাপাশি সরকারকেও পদক্ষেপ নিতে কাজ করতে হবে। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা চার্ট অনুযায়ী ভাড়া নিচ্ছি। কিলো হিসেবে নিচ্ছি না। সব বাসে ই-টিকিট সেবা চালু হয়নি। আমাদের একটু সময় দিন ধীরে ধীরে সব বাসের ই-টিকিটে উঠা-নামার স্থানসহ সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।