রামপালে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২১, ২০২২, ০১:১৩ এএম

একযুগ পর জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে ৬৬০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ। নির্মাণকাজ শুরুর একযুগ পর প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে বাগেরহাটের রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর আগে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে ইউনেস্কো।

২০১২ সালে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র্র নিয়ে ইউনেস্কো যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে সুন্দরবনের কী ধরনের ক্ষতির আশঙ্কার কথা রয়েছে। ৩০ পৃষ্টার দীর্ঘ এই রিপোটে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের মূলত চার ধরণের ক্ষতির আশংকার কথা তুলে ধরা হয়।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে কয়লা পুড়িয়ে। এই কয়লা পোড়ানোর পর সেখান থেকে থেকে নির্গত কয়লার ছাইকে সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য এক নম্বর হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়  ইউনেস্কোর এই প্রকল্পে। বিদ্যুৎকেন্দ্র্র থেকে নির্গত বর্জ্য এবং পানিকে দ্বিতীয় হুমকি হিসেবে গণ্য করছে ইউনেস্কো।

এছাড়া এই প্রকল্পকে ঘিরে সুন্দরবন এলাকায় যেভাবে জাহাজ চলাচল বাড়বে এবং ড্রেজিং করার দরকার হবে, সেটিও সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আর সবশেষে বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে ঐ অঞ্চলের সার্বিক শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন কর্মাকাণ্ডও সুন্দরবনের পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে মনে করে ইউনেস্কো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান বিদ্যুৎ সংকটে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কিঞ্চিত উপকার হলেও এর ক্ষতির প্রভাব সুদূর প্রসারী। এক সময় রামপাল মরণঘাতিতে রূপ নিবে। দক্ষিণ এশিয়ার ফুসফুস খ্যাত সুন্দর বন ধ্বংসের পায়তারা করছে একটি মহল। যা এখন বাস্তায়নে রূপ নিচ্ছে। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় অবস্থিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট করে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রথম ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

এর মধ্যে ৪৬০ মেগাওয়াট গোপালগঞ্জের আমিন বাজার হয়ে ঢাকার জাতীয় গ্রিডে এবং ২০০ মেগাওয়াট খুলনা-বাগেরহাটে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে।

এরই মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিটের সার্বিক কাজের ৮০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া শুরু করে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিটেরও ৭৯ দশমিক ৩৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে দ্বিতীয় ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ২০২৩ সালের জুন মাসে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।

আলোচিত-সমালোচিত ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ চুক্তিতে ২০১০ সালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ঠিক বার বছর পর প্রথম ইউনিট থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে আরও ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তির একযুগ পরে হলেও, জাতীয়গ্রিডে বিদ্যুৎ যুক্ত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয়রা। তবে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত পরিবেশকর্মী ও সচেতন মহল।

২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের এনটিপিসি লি. এর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লি. (বিআইএফপিসিএল) নামে কোম্পানি গঠিত হয়। এই কোম্পানির অধীনে ১৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল) নামে রামাপাল উপজেলার রাজনগর ও গৌরম্ভা ইউনিয়নের সাপমারী কৈ-গর্দ্দাশকাঠি মৌজায় ১ হাজার ৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ শেষে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু হয়।

২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই শুরু হয় জমি ভরাট ও সড়ক নির্মাণের কাজ। প্রায় ৯ বছর বিশাল কর্মেযজ্ঞ শেষে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে গেল প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে চলতি বছরের ১১ জুলাই বয়লার স্টিম ব্লোয়িং স্থাপন করা হয়। এক মাস পরে ১৪ আগস্ট টারবাইনে স্টিম ডাম্পিং এবং একদিন পর ১৫ আগস্ট জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ (ট্রান্সমিশন) শুরু করা হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক সদস্য বলেন, পরিবেশ দূষণ ও সুন্দরবন ধ্বংস করে আমরা বিদ্যুৎ চাই না। রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প রয়েছে, কিন্তু সুন্দরবনের বিকল্প নেই। বিষয়টি সসবাইকে বিবেচনা করার দাবি জানান এই পরিবেশকর্মী।

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপ-ব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম বলেন, প্রথম ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে  ৪০০ মেগাওয়াট গোপালগঞ্জের আমিন বাজার হয়ে ঢাকার জাতীয় গ্রিডে এবং ২৬০ মেগাওয়াট খুলনা-বাগেরহাটে সরবরাহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় ইউনিটের ৭৯.৩৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে । সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দ্বিতীয় ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াটের কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালের জুন মাসে।

রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা রবীন্দ্র কুমার আমার সংবাদকে বলেন, ধীরে ধীরে মেশিনের কার্যক্রম বাড়াচ্ছি, আমাদের দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে স্থানীয় বিদ্যুতের চাহিদা পূরনের পাশাপাশি জাতীয় বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা বিভাগ পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন আমার সংবাদকে বলেন, আমরা প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছি, তারা পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন দেবে। তখনই বাণিজ্যিক উৎপাদনের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ডিসেম্বরের শেষ দিকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এখন সফলভাবে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলছে।

এক যুগ আগে ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই শুরু হয় জমি ভরাট ও সড়ক নির্মাণের কাজ। প্রায় নয় বছর বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে গেল প্রতিষ্ঠানটি।

এর আগে এ বছরের ১১ জুলাই বয়লার স্টিম ব্লোয়িং স্থাপন করা হয়। এক মাস পর ১৪ আগস্ট টারবাইন-এ স্টিম ডাম্পিং এবং এক দিন পর ১৫ আগস্ট জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ (ট্রান্সমিশন) শুরু করা হয়।

উল্লেখ্য, রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং ভারতের এনটিপিসি যৌথ কম্পানি গঠন করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০১০ সালে ভূমি অধিগ্রহণ শুরুর পর ২০১২ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়। মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড (বিএইচইএল)।

১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে কয়লা ভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো চালু হয়নি। এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন।