মূল্যস্ফীতিতে লাগামহীম অর্থনীতি। এর মধ্যেই আবারও বাড়ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি শূন্যের কোটায় নিয়ে আসবে সরকার। করোনা অভিঘাত ও তৎপরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ভর্তুকি দিতে চাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
চলমান ভর্তুকিকে তারা বোঝা মনে করছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সর্বশেষ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য সমন্বয় ঘোষণা অনুযায়ী, যদি ভর্তুকি দেয়া বন্ধ করা হয়, তাহলে বিদ্যুতের দাম প্রতি কিলোওয়াটে ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে আট টাকা ৩০ পয়সা এবং গ্যাসের দাম ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি ঘনমিটারে ১১ টাকা ৬২ পয়সা হবে। বিদ্যুৎ-গ্যাস খাতে আর ভর্তুকি না দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, জ্বালানি খাতের ভর্তুকি জনগণকেই বহন করতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস কেনার প্রকৃত ব্যয় পরিশোধের জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
করোনা অভিঘাত ও তৎপরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ভর্তুকি দেয়া সম্ভব হবে না বলেও জানান তিনি। বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুতের ভর্তুকি ১৭ হাজার কোটি টাকা ও গ্যাসের ভর্তুকি ছয় হাজার কোটি টাকা।
এদিকে খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক সভায় বলেন, সরকারকে যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অনেক বেশি বোঝা। সরকার এখন যেকোনো মূল্যে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে ভর্তুকি কমাতে চায়। জ্বালানির দাম বাড়ানো কমানোর বিষয়ে মূলত কাজ করে থাকে বিইআরসি। দাম কমানো বাড়ানোর একক ক্ষমতা এত দিন বিইআরসির হাতেই ছিল।
সম্প্রতি এ আইন সংশোধন করা হয়। কোনো ধরনের গণশুনানি ছাড়াই সরকার এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। এর আগে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন-২০০৩-এর সংশোধন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে সরকার। এর আগে জ্বালানির দাম বাড়ানোর আইনগত ক্ষমতা ছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসির। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের আগে অংশীজনদের নিয়ে গণশুনানি করত বিইআরসি।
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অযৌক্তিক বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার ভিত্তিক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, এর আগে রাতের আঁধারে কোনো প্রকার বাছ-বিচার কিংবা শুনানি না করেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫০ শতাংশ।
এরফলে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এখন আবার দাম বাড়লে আরেক দফা বাড়বে মূল্যস্ফীতি। ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, উচ্চমূল্যের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে, একই কারণে স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ। এখন তো বিদ্যুতের দাম কমানো উচিত। কিন্তু অযৌক্তিকভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। জ্বালানির দাম বাড়লে বাড়বে সব ধরনের পণ্যের দাম। অস্থির হবে অর্থনীতি। এদিকে তীব্র লোডশেডিং ও গ্যাস স্বল্পতার সময়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করে হলেও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের প্রস্তাব দেন সরকারকে।
তখন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, ভর্তুকি তুলে দিলে ষ এরপর ডিজেলের দামও লিটারে চার থেকে পাঁচ টাকা বাড়ানো হবে। এদিকে বিপিসি বলছে ডিজেলে ভর্তুকি দেয় এবং পেট্রোল ও অকটেনে লাভ করে।
গত সাত বছরে বিপিসি ৪৮ হাজার ১১৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। কিন্তু, ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাটির লোকসান শুরু হয়। এই লোকসানই এখন বিপিসির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য সহনশীল রাখতে দীর্ঘদিন ধরেই এসব খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার। ফলে সংকট মুহূর্তে ভর্তুকির চাপ নিতে পারছে না সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের এ সময় ভর্তুকি দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হিসাবে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে বিদ্যুতে প্রায় ৩৪ শতাংশ ও গ্যাসের দাম বাড়বে প্রায় ৩১ শতাংশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে তেল ও খাদ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। টানা কয়েক মাস এসব পণ্যের দাম অনেকটাই বাড়তি ছিল।
তবে সুখবর হচ্ছে— বিশ্ববাজারে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখন অনেকটাই কমে এসেছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল ও খাদ্যের দাম যুদ্ধ-পূর্বাবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। তবে দেশে বাড়ানোর কথাই বলছে সরকারের পক্ষ থেকে। জ্বালানির দামের ওপর অনেক ধরনের পণ্যের দাম নির্ভর করে। সে জন্য জ্বালানির দর মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবতা হচ্ছে— জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণেই মূলত চলতি বছর বিশ্বের দেশে দেশে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি হয়েছে। প্রসঙ্গত, চলতি বছর ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। সে সময় বিপিসি জানায়, ওই মুনাফা বিগত পাঁচ মাসের লোকসান মেটাতে ও একটি অংশ উন্নয়ন কাজেও ব্যয় করা হয়েছে। বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, দাম সমন্বয়ের পরও এখনো বিপিসির প্রতি লিটারে চার থেকে পাঁচ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।