রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন

প্রচারণা শেষ ঝুঁকিতে ৮৬ কেন্দ্র

মিজানুর রহমান মিজান, রংপুর প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৬, ২০২২, ১২:৪১ এএম

রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক) নির্বাচন আগামী ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সে অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণার শেষ দিন আজ। নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী রোববার রাত ১২টা থেকে গণসংযোগ, পথসভাসহ সব ধরনের প্রচারণা বন্ধ থাকবে।

এদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্নের লক্ষ্যে প্রায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন নির্বাচন কমিশন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে ৩৩টি ওয়ার্ডে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট। মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

থাকছে র্যাব ও বিজিবির স্ট্রাইকিং ফোর্স। নির্বাচনি প্রচারণার শেষ দিনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ছোটখাটো দু’-একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মেয়র প্রার্থীদের প্রচারণা ছিল চোখেপড়ার মতো। প্রার্থীদের মধ্যে বাকযুদ্ধ থাকলেও প্রচারণা ঘিরে ছিল না কোনো উত্তেজনা। উৎসবের প্রচারণায় ঘনিয়ে আসা ভোট শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে এমনটাই প্রত্যাশা সাধারণ ভোটার নগরবাসীর।

রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস সূত্রে জান গেছে, এবার সাতটি রাজনৈতিক দলের সাতজনসহ ৯ প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিন্দন্দ্বিতা করছেন। তবে বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে গ্রহণ করেনি। এছাড়াও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা তফসিল ঘোষণার আগে থেকে পচারণা চালানোর পর মনোনয়পত্র কিনলেও শেষ পর্যন্ত তা জমা দেননি তিনি। নির্বাচনি প্রচারণায় অন্যান্য প্রার্থীর তুলনায় এগিয়ে ছিলেন সদ্য সাবেক মেয়র জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তবে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই জানা যাবে জয়ের মালা কার গলায় উঠছে।

রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন জানান, রোববার রাত ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবে নির্বাচনি সব রকমের প্রচার-প্রচারণা। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের এই নির্বাচনে ১১ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানান তিনি।

ইভিএম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিটি কেন্দ্রে যে পরিমাণ ইভিএম ব্যবহার হবে, তার দ্বিগুণ ইভিএম আমরা প্রস্তুত রেখেছি। কোনোখানে ইভিএমএ সমস্যা হলে সেটি কেন্দ্র থাকা টেকনিক্যাল লোকজন ঠিক করে দেবে। যদি তারা ব্যর্থ হয় তবে মোবাইলে থাকা টেকনিক্যাল টিম সেটি ঠিক করবে। যদি তারাও ঠিক করতে না পারেন, তাহলে ওই কেন্দ্রের ভোট যতটুকু ওই ইভিএমে নেয়া হয়েছে ততটুকু অক্ষুণ্ন থাকবে। সবার উপস্থিতিতে সেটিও সংরক্ষণ করে রাখবে এবং নতুন আরেকটি ইভিএম ব্যবহার করবে।

তিনি বলেন, আমরা পুরো নির্বাচনি এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেবো। প্রতিটি কেন্দ্রে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করব। সেখানে প্রতিটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে এক প্লাটুন অর্থাৎ ১১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ১১ প্লাটুন বিজিবি থাকবে। দুটি কেন্দ্রের জন্য একটি র্যাবের টিম থাকবে। কেন্দ্রে পুলিশ অস্ত্রসহ এবং অস্ত্র ছাড়া থাকবে। বিজিবি ও র্যাবের স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে থাকবে। প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং সংরক্ষিত ১১টি ওয়র্ডেও জন্য  জন্য ১৬ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে থাকবেন। তারা নিজ নিজ ওয়ার্ডে আচরণবিধি ভঙ্গ হচ্ছে কি-না, সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। পাশাপাশি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা এর থেকেও কোনো বেশি নির্বাচনি অপরাধ থাকে সেগুলোর জন্য মামলা নেয়া ও শাস্তি দেওার কাজ করবে।

২০১২ সালের ২৮ জুন ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হয় রংপুর সিটি কর্পোরেশন। গঠনের পর ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো দলীয়  প্রতীক ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবার এক লাখ ছয় হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সদ্য সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট এবং বিএনপি নেতা কাওসার জামান বাবলা পেয়েছিলেন ২১ হাজার ২৩৫ ভোট। ২০১২ সালের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন তিন লাখ ৫৭ হাজার ৭৪২ জন।

এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৭৯ হাজার ১২৮ জন এবং নারী ভোটার এক লাখ ৭৮ হাজার ৬১৪ জন। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর দলীয় প্রতীকে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এক লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু পেয়েছিলেন ৬২ হাজার ৪০০ ভোট এবং বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা পেয়েছিলেন ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট। ওই বছর ভোটার সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৯৬ হাজার ৩৫৬ ও নারী এক লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৮ জন।

এবার ভোটার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে চার লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ১২ হাজার ৩০২ জন এবং নারী ভোটার দুই লাখ ১৪ হাজার ১৬৭ জন। তৃতীয় দফায় ২৭ ডিসেম্বর ২২৯টি কেন্দ্রের ১৩৪৯টি কক্ষে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪ পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির মোস্তাাফিজার রহমান মোস্তফা, আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) শফিয়ার রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিরুজ্জামান পিয়াল, খেলাফত মজলিশের তৌহিদুর রহমান মণ্ডল রাজু, জাকের পার্টির খোরশেদ আলম খোকন, বাংলাদেশ কংগ্রেস পার্টির আবু রায়হান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেহেদী হাসান বনি ও লতিফুর রহমান মিলন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া সংরক্ষিত ১১টি ওয়ার্ডে ৬৮ এবং ৩৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৮৩ জন কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।

এদিকে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৮৬টি কেন্দ্র ঝুঁকিতে রয়েছে, যেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন। নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওই কর্মকর্তা জানান, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ডের ২২৯টি কেন্দ্রের মধ্যে কোতোয়ালি থানায় ৩৭টি, তাজহাট থানায় আটটি, মাহিগঞ্জ থানায় ৯টি, হারাগাছ থানায় ৯টি, পরশুরাম থানায় ১৩টি ও হাজিরহাট থানায় ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র রয়েছে।

কী কারণে এসব কেন্দ্র ঝুঁকিতে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এসব কেন্দ্রে ভোটার বেশি। কেন্দ্রে সীমানা প্রাচীরও নেই। কেন্দ্র এলাকায় অতীতে সংঘাত হয়েছে। তাই এগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে। এদিকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে কঠোর অবস্থানে নির্বাচন কমিশন। রংপুর সিটি এলাকাগুলোতে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নগরীতে রোববার রাত থেকে ১১ প্লাটুন বিজিবি, ১৭ প্লাটুন র‌্যাব ও ৩৩ প্লাটুন পুলিশ থাকবে। মাঠে থাকবে ৩৩ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৬ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

রংপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সব আয়োজন করা হয়েছে। যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর। আশা করছি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারব।’