ভোটধিকার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশে কড়া নজরদারি রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোকে কানা চোখে দেখছে রাশিয়া। দেশ পেরিয়ে এখন বিদেশের মাটিতেও চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। এ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজন আরো বাড়ল। একটি বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে এমনিতেই বাংলাদেশের অনেক ভাবর্যাদা নষ্ট হয়েছে।
কুটনৈতিক বিষয়ে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সাথে কারও শত্রুতা নেই, দেশের কেউ সঙ্ঘাতের ক্ষেত্র চায় না। একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের মন্তব্য যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রভাব ফেলছে, অপরদিকে রাশিয়ার মন্তব্যও একই নীতিতে জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন বলে মনে করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাড়িতে যাওয়ায় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ঘটনাটি নিয়ে ওয়াশিংটনেও আলোচনা হয়েছে। কারা ওইদিন তাকে ঘিরে ধরেছে— এর জবাব চাওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। ১৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সাথে আলোচনায় পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
ওই ঘটনায় রাশিয়া বলছে— ঘিরে ধরার ঘটনাটি মার্কিন কূটনীতিকের তৎপরতার প্রত্যাশিত ফল। তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে প্রভাব বিস্তার না করতে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে। দু’দফায় পাঠানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তি। এমন দৃশ্যপটে দু’দেশের স্নায়ুযুদ্ধ অনেকদূর এগিয়ে গেছে বলেও মনে করা হচ্ছে। ভূ-রাজনীতির কারণে আন্তর্জাতিক যে ঘুঁটি চলবে তাতে বাংলাদেশের এখন অনেক সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে যে হস্তক্ষেপ তৈরি হয়েছে এর কারণে আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজন অনেক বেশি বেড়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতি কিংবা কোনো স্বার্থ নিয়ে একটি দেশ হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছে সেটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি স্পষ্ট হওয়ার পর বিপরীত যে রাষ্ট্র রয়েছে রাশিয়া— তারা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা দেশটিকে বিবৃতির মাধ্যমে সতর্ক করে দিয়েছে।’
একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে যাওয়া তাদের খোঁজখবর নেয়া— এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অংশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ঢুকে পড়ছে, যার কারণে রাশিয়া সতর্ক করে দিয়েছে— তারা যেটি করছে এটি ঠিক করছে না। তাই বলা চলে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অতি জটিলতা তৈরি না হলেও আমাদের সতর্কতার অবকাশ রয়েছে। নীরবতায় বাংলাদেশ নিয়ে দুই দেশের স্নায়ুযুদ্ধ অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছে। তবে আমরা আমাদের জায়গা থেকে যতটুকু উপলব্ধি করছি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে অন্য কোনো দেশ হস্তক্ষেপ না করাই ভালো। এতে যতটা সমাধান তৈরি হয়, তাতে আরো জটিলতা বেশি তৈরি হয়— অতীতের দৃশ্যগুলো এমন বার্তা দেয়। স্বার্থের কারণে ডিপ্লোম্যাটিক চিন্তার অংশ থেকে উভয় দেশ তাদের কার্যক্রম করে যাচ্ছে— আমাদেরও আরো ভূমিকা পালন করতে হবে।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘রাশিয়া বলছে বাংলাদেশের বিষয়ে নাক গলানো গ্রহণযোগ্য নয়। আবার তারাই ইউক্রেনে সেনা পাঠাচ্ছে, এটি তো হতে পারে না। রাশিয়া এক হিসেবে আমাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যদিও সেটি পুরোপুরি তাদের নিজেদের স্বার্থে নিয়েছে, আমাদের স্বার্থে নয়। এখন সেটি বিরোধিতা করাও সরকারের জন্য কঠিন। রাশিয়া পক্ষ নিয়েছে, কিন্তু যেভাবে নিয়েছে, সেটিও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর শামিল।’
তিনি বলেন, ‘এটি স্বাগত জানানোর মতো বিষয় নয়। আমি মনে করি না, বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো দেশের অস্বস্তিকর সম্পর্ক রয়েছে যে, এখানে দুইপক্ষ তাদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এটি কাম্য নয়। এখানে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিষয়ে কী বলছে, সেটি রাশিয়ার বিষয় নয়। আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সামলাব।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া যেটি করে যাচ্ছে এটি হচ্ছে ভূ-রাজনীতির অংশ। এ জন্য একটি দেশ আরেকটি দেশকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। এটি এখন স্পষ্ট— এখন পুরো পৃথিবীটাই বিভাজিত। তাই রাজনীতিও বিভাজিত পলিসির মধ্যে পড়ে গেছে। যার প্রকাশ পাচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে দুই দেশের হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে রাজনীতির অংশে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে রাশিয়া নড়েচড়ে বসে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছে । গণতন্ত্র ও ইলেকশনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে আওয়াজ চলছে এটি ভূ-রাজনীতির অংশের মধ্যে পড়ে গেছে। যার কারণে রাশিয়া তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।’ তবে এ দুদেশের স্বার্থের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতির অংশ অনেক গভীরে চলে গেছে বলেও মনে করছেন এ বিশ্লেষক।
ঘিরে ধরার ঘটনাটি মার্কিন কূটনীতিকের তৎপরতার প্রত্যাশিত ফল —জানাল রাশিয়া : ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে যাওয়াকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের চেষ্টা মনে করে রাশিয়া। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কোর স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এই মন্তব্য করেন। ঢাকার রুশ দূতাবাস রোববার সকালে মারিয়া জাখারোভার বিবৃতিটি প্রচার করেছে।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, তারা বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা ঘিরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত ঘটনাটি লক্ষ করেছেন। তিনি ২০১৩ সালে নিখোঁজ বিরোধী দলের এক নেতার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি সংগঠনের লোকজনের কারণে তার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। সংগঠনটির লোকজন রাষ্ট্রদূতের সেখানে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন না।
মারিয়া জাখারোভা বলেন, ঘটনাটি মার্কিন কূটনীতিকের তৎপরতার প্রত্যাশিত ফল। যিনি বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষার নামে ক্রমাগত দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। মারিয়া জাখারোভা বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার মৌলিক নীতি লঙ্ঘন করে, এমন পদক্ষেপগুলো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ পিটার হাসের, জবাব চাইলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে : রাজধানীর শাহীনবাগের ঘটনা নিয়ে গত ১৫ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক করেন ঢাকায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সেখানে তিনি তার ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার কথা উল্লেখ করে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। গেলো সপ্তাহে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় যান পিটার হাস। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাসার বাইরে একদল লোক তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করে। তিনি নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় সেখান থেকে বেরিয়ে যান।
এ বিষয়ে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র সাংবাদিক জানান, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকায় বৈঠক শেষ না করেই সুমনের বাসা থেকে চলে আসেন পিটার হাস। বিষয়টি তারা সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন ওরা কারা। শাহীনবাগ থেকে আসার পর দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত জরুরি ভিত্তিতে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বললেন যে, তিনি এক বাসায় গিয়েছিলেন, আর সেখানে যখন গেছেন, কিন্তু বাইরে বহু লোক ছিল। তারা তাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। তার সিকিউরিটির লোকেরা তাকে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। তারা বলেন যে ‘‘ওরা আপনার গাড়ি ব্লক করে দেবে’। সেই নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা থেকে তিনি তখন তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে যান এবং এতে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন।’