- উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার ২০২২ শেষে শুরু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বছর ২০২৩
- মূল্যস্ফীতি, অর্ধেকে নেমে আসা এলসি, গভীর ঘুমে পুঁজিবাজার, রেকর্ড খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ইসলামী ধারার ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম, রিজার্ভে চাপ, ডলার সংকট ও রেকর্ড দাম, দ্রব্যমূল্যে ভোক্তার নাভিশ্বাস, জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বৃদ্ধির চাপে কোণঠাসা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই এবার বড় চ্যালেঞ্জ
- সম্ভাবনা ও আশার আলো দেখাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক যাত্রা
- জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রক্ষা কঠিন হবে —বলছেন বিশেষজ্ঞরা
- রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি অন্যতম চ্যালেঞ্জ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘দূর হইলো দৈন্যদ্বন্দ্ব/ছিন্ন হইলো দুঃখবন্ধ/উৎসবপতি মহানন্দ/তুমি সুন্দরতম।’ সত্যিকারের সুন্দরের প্রত্যাশায় পুবের আকাশে উদিত হয়েছে নতুন সূর্য। ছড়িয়ে পড়েছে তার আলো কুয়াশার চাদর ভেদ করে। আজকের সূর্যোদয় নিয়ে এসেছে নতুন বারতা, নতুন আনন্দধারা। বিগত দিনের সব ভুল, হতাশা, দুঃখ, গ্লানি মুছে দিয়ে আজ শুরু হবে নতুন উদ্যমে সফলতার পানে এগিয়ে চলা। যদিও ধারণা করা হচ্ছে— এ পথচলা অতীতের মতো মসৃণ হবে না। মোকাবিলা করতে হবে ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সব চ্যালেঞ্জ এবং এ বছরই কঠিন সব চ্যালেঞ্জ জয়ে পাড়ি জমাতে হবে কণ্টকাকীর্ণ পথে— এমনটাই বলছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়েই গেল বছর-২০২২ অতিক্রম করলেও বছরটিতেই ছিল করোনার ধাক্কা সামলিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। যদিও এর অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বব্যাপী এই যুদ্ধের ছোবল লেগেছিল, লেগেছে বাংলাদেশেও। যার মাশুল এখনো গুনছে বাংলাদেশ। উল্টো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে বরণ করা গেলো বছর ‘২০২২-এ’ ও যুদ্ধ করতে হয়েছিল টিকে থাকার। এবার বরণ করা নতুন বছরটিতেও সব কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে এটি অন্যতম, এই চ্যালেঞ্জের মুখেও জানাতে হচ্ছে স্বাগতম-২০২৩। তবে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিকসহ নানা কারণেও গুরুত্বপূর্ণ ২০২৩ বছরটিতেই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং দেশের উন্নয়নে সরকার গৃহীত বহুমুখী উদ্যোগের পূর্ণতা পাবে যেখানে ইতোপূর্বেই উন্নয়নে নেয়া বহু উদ্যোগের পূর্ণতা পেয়েছে। সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখেও অগ্রগতির পথে দূর হবে সব জটিলতা— এমনটাই আজ প্রত্যাশা সবার।
২০২৩ সাল, ইতিহাসের কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এলেও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশারও কমতি নেই। কঠিন মুহূর্তেও জাতির সামনে সম্ভাবনা রূপে আভির্ভুত হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যার উদ্বোধন হয় গত ২৫ জুন। এরই মধ্যে এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ-ব্যবস্থায় ঘটিয়েছে বড় পরিবর্তন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু ভবিষ্যতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়াবে। যার প্রতিফলন ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। পদ্মার এপার-ওপারে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার হতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালেও চ্যালেঞ্জ জয়ে নিয়ামক ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে এ সেতু। একইভাবে আশাজাগানিয়া খবর হচ্ছে— মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক যাত্রা। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় অভাবনীয় পরিতর্বন ঘটানো মেট্রোরেল উদ্বোধন হয় গত ২৮ ডিসেম্বর। তবে বাণিজ্যিক এই যাত্রা শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের একাংশের। এর মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক রেলের যুগে প্রবেশ করল দেশ। মেট্রোরেল ঢাকায় তীব্র যানজট সমস্যার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। মেট্রোরেল ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন বাড়াবে গতি, তেমনি কঠিন চ্যালেঞ্জের বছরে অর্থনীতিতে সঞ্চার করবে নতুন প্রাণের। আপাত দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ দুটি প্রকল্প বড় ভূমিকা রাখলেও ঠিক এ মুহূর্তেই আশাজাগানোর মতো তেমন আর কোনো খবর নেই। তবে শঙ্কিত হওয়ার খবর রয়েছে একাধিক, যে খবর আগত বছরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অন্তরায়। এর অন্যতম একটি প্রবাসী আয়ে নিম্নগতি। অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেল চাঙা হওয়ায় আগত বছর দেশে প্রবাসী আয় শত কোটি ডলার কমবে বলে বিশ্বব্যাংকের সমপ্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসেই প্রবাসী আয় ১৬০ কোটি ডলারের নিচে ছিল। চলতি মাসের প্রথম ২৩ দিনে (১-২৩ ডিসেম্বর) দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১২৮ কোটি ৪২ লাখ ডলার। অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স প্রবাহে ২ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও অর্থবছর শেষে এই প্রবৃদ্ধি থাকবে কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বিদায়ী বছরে মূল্যস্ফীতি, এলসি খোলার পরিমাণ অর্ধেকে নামা, গভীর ঘুমে পুঁজিবাজার, রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, ইসলামি ধারার ব্যাংক ঋণে অনিয়ম, রিজার্ভে চাপ, ডলার-সংকট রেকর্ড দাম, দ্রব্যমূল্যে ভোক্তার নাভিশ্বাস, জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বৃদ্ধির চাপে কোণঠাঁসা দেশের অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের একটি।
এ ছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কাও। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনকে ঘিরে ২০২৩ সালে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা করছেন অনেকে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। যার সুফল পেয়েছে অর্থনীতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) বাড়তে বাড়তে করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। করোনার মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে দেশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে দেশে। ধারাবাহিক এই প্রবৃদ্ধি দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণেই সম্ভব হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে যদি আবার হরতাল-অবরোধ-জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়, তাহলে সেটি আর ধরে রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। অবনিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের বিষয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে শঙ্কা। বিদায়ী বছরে দেশের মানুষ ঢাকা ছাড়াও ভোলা, নারায়গঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়াসহ পঞ্চগড়ে দেখেছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এ ছাড়াও র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে চারজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ১৫ জনের মৃত্যুর খবরেও শঙ্কিত দেশের মানুষ। এ ছাড়া বিদায়ী বছরের শেষের দিকে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র ফারদিন হত্যাকাণ্ড নিয়েও সৃষ্টি চাঞ্চল্যের। যে হত্যাকাণ্ডের সঠিক সুরাহা এখনো দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণও কঠিন সবকটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম একটি। যে কারণে আইন ও সালিশকেন্দ্র মানবাধিকার নিশ্চিতের বিবেচনায় ১৪টি সুপারিশও করেছে।