সংকটের মধ্যে নতুন করে দাম বাড়ানো নৈতিক স্খলনের শামিল— এম শামসুল আলম
দাম বৃদ্ধি করে সরকার গণবিরোধী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে— বিএনপি
নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো স্বেচ্ছাচারী ও হটকারি সিদ্ধান্ত— বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পর এবার বাড়ল গ্যাসের দামও। এক লাফে গ্যাসের দাম তিনগুণ বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। করোনা অভিঘাতে স্থবির হয়ে পড়ে দেশের অর্থব্যবস্থা। এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অধিকাংশ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির এক সপ্তাহ পর গ্যাসের এমন দাম বৃদ্ধিতে উষ্মা প্রকাশ করেছেন ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা। অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরাও।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ না নিয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে সর্বত্র উৎপাদন খরচ বাড়বে। ওই বাড়তি দামও সাধারণ মানুষের পকেট থেকে তুলে নেয়া হবে। আমদানি বন্ধ থাকার পরও বারবার দাম বৃদ্ধি করা কোনো অশুভ লক্ষণ থাকতে পারে বলে মনে করেন তারা। দফায় দফায় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। দ্রুত গ্যাস-বিদ্যুতের দাম প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক-পেশাজীবী ও ভোক্তা সংগঠন।
ব্যবাসায়ীরা বলছেন, এই দাম বৃদ্ধির চাপ নেয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই। তারা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকলেও দাম বৃদ্ধি করে তামাশা করছে সরকার। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পর এবার গ্যাসের মূল্য প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি সরকারের গণবিরোধী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করে চরম দুর্ভোগে থাকা জনগণকে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের এক দফা দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে ‘স্বেচ্ছাচারী ও হটকারি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, জবাবদিহিবিহীন সরকার জনগণের ওপর একের পর এক দুর্ভোগ চাপিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চুরি, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর না করে তার জন্য উল্টো শাস্তি দেয়া হচ্ছে জনগণকে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ দফায় দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমদানি বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিদেশ থেকে বাড়তি দাম দিয়ে কিনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানো হবে। এ জন্য বেশি টাকা লাগবে। ভর্তুকি কমাতে সেই টাকার একটা অংশ ওঠানো হবে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে। ব্যবসায়ীরা বাড়তি দাম দিতে রাজি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পাঁচ টাকা দুই পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছে। এছাড়াও ক্যাভটিভ পাওয়ার (শিল্প-কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন) খাতে গ্যাস প্রতি ঘনমিটারে দাম ১৬ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা, বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং ক্ষুদ্র শিল্পে ১০ দশমিক ৭৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে।
এছাড়াও বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগে প্রতি ঘনমিটারের দাম ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে প্রজ্ঞাপনে আবাসিক গ্রাহকদের এক চুলার দাম আগের মতোই ৯৯০ টাকাই রাখা হয়েছে। একইভাবে দুই চুলার দাম ১০৮০ টাকাই আছে। সিএনজিতেও প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকা এবং চা শিল্পের গ্যাসের দামও আগের মতো প্রতি ঘনমিটার ১১ টাকা ৯৩ পয়সাই আছে।
একইসঙ্গে সার কারখানায় ব্যবহূত গ্যাসের দামও আগের মতোই আছে। জরুরি এই খাতটিতে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম আগের মতো ১৬ টাকাই রাখা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, প্রতি ঘনমিটার সিএনজি মূল্যহারের মধ্যে ফিড গ্যাসের মূল্যহার ৩৫ টাকা ও অপারেটর মার্জিন আট টাকা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এদিকে গৃহস্থালি ছাড়া অন্যান্য গ্রাহকশ্রেণি যেমন বিদ্যুৎ (সরকারি, আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র), ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট, স্মল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র), সার, শিল্প, চা-শিল্প (চা-বাগান), বাণিজ্যিক (হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য) এবং সিএনজির ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে (মাসিক অনুমোদিত লোডের বিপরীতে) ১০ পয়সা হারে ডিমান্ড চার্জ প্রযোজ্য হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ায় জনজীবনে সরাসরি প্রভাব না পড়লেও পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়বে। এদিকে সরকার বলছে, এই দাম বৃদ্ধির ফলে তাদের ভর্তুকি কমবে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি কিনতে গিয়ে পেট্রোবাংলা আর্থিক সংকটে রয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে।
আইএমএফ ঋণ ছাড়ের আগেই ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছিল। সরকার ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দামের পর এবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা গ্যাস সংকটে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। উৎপাদনের মাত্রা ধারাবাহিক হ্রাস হতে চলছে। বন্ধ হচ্ছে একের পর এক শিল্প-কারখানা। স্বপ্ন ভঙ্গের আশঙ্কা হাজার হাজার ব্যবসায়ীর। তাই তারা চাচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস। ব্যবসায়ীরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের। বাড়তি দামেও রাজি তারা।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার অতীতে এলএনজি আমদানির কথা বলে দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু সেই পরিমাণে গ্যাস আমদানি করা হয়নি। এতে পেট্রোবাংলার কাছে উদ্বৃত্ত অর্থ রয়ে গেছে। গত বছরের জুন মাসে যে দাম বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে তারপর স্পট মার্কেটের এলএনজি আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। এতে অনেক মুনাফা করছে পেট্রোবাংলা। বিতরণ কোম্পানিগুলো এখনই মুনাফায় রয়েছে এখন দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস। প্রতিনিয়ত জীবন যাত্রায় খরচ বাড়ছে, বিপরীতে বাড়েনি আয়।
সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসায়ী নেতাদের পরামর্শেই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পেতে চান। চড়াদামে এলএনজি আমদানি করলে গ্যাসের দর বেড়ে যাবে। যে কারণে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হলে দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। সরকারের এমন প্রস্তাবে ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব ছিল, তারা বাড়তি দামই দিতে রাজি আছেন। তাদের সেই প্রস্তাব কার্যকরের প্রক্রিয়া চলমান।
বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি তার হিসাবে বলেছিল, ২০১৯-২০ অর্থবছরে গড়ে দৈনিক ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি বিবেচনায় দর নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে গড়ে ২৯২ মিলিয়ন কম হয়েছে। এতে প্রতি ঘনমিটারে ২.৪০ টাকা হারে কমে মোট ব্যয় কমেছে ৭২ হাজার ৮৪৩ মিলিয়ন টাকা। একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে দৈনিক গড়ে ৬৮৪.৮৪ মিলিয়ন এলএনজি বিবেচনায় মিশ্রিত ক্রয়মূল্য দাঁড়িয়েছে ১২.৪৭ টাকা। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের (এলএনজি) দাম বৃদ্ধির ধোঁয়া তুলে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ দাম বাড়িয়ে দেয় বিইআরসি।
তখন সার উৎপাদনে ২৫৯ শতাংশ, শিল্পে ১১.৯৬ শতাংশ (বৃহৎ শিল্পে ১১.৯৮ টাকা, মাঝারি শিল্পে ১১.৭৮ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১০.৭৮ টাকা, চা শিল্পে ১১.৯৩ টাকা) বিদ্যুতে ১২ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। আবাসিকে একচুলার দর ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৮০ টাকা করা হয়। প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের ইউনিট প্রতি দর ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা, সার উৎপাদনে ঘনমিটার ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়।
গ্যাস খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপচয় কমিয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করে দাম না বাড়ানো যেত বলে মনে করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, শিল্পসহ সব গ্রাহক গ্যাসের খরায় ভুগছে। এর মধ্যে নতুন করে দাম বাড়ানোর কোনো নৈতিক অবস্থান নেই সরকারের। এটা গ্রাহকের কাছ থেকে লুণ্ঠনের শামিল, চরমতম প্রতারণা।
এদিকে বিইআরসি গণশুনানি করে গ্যাসের দাম বাড়ালেও এবারই প্রথম সরকারের নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো হলো। এতদিন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত বিইআরসি একাই। গত ১০ জানুয়ারি বিশেষ প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ এবং সমন্বয়ে সরাসরি সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ রেখে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০২৩’-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
গত সপ্তায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরই গতকাল গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খণিজসম্পদ বিভাগ। এর আগে ভোক্তাপর্যায়ে সবশেষ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল গত বছরের ৪ জুন। এর আগে ২০১৮ সালের শেষভাগে এলএনজি আমদানির সময় থেকে সরকারের খরচ বাড়তে শুরু করে এবং তখন এই ঘাটতি পূরণ করতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে গ্যাসের দাম পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে ১৭৪ শতাংশের বেশি।
টিএইচ