অবহিত করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ হবে
—ইউএনও, নাইক্ষ্যংছড়ি
`আজাদের লড়াই`য়ে অর্থাৎ স্বাধীনতার লড়াইয়ে রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বিরুদ্ধে লড়ছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যরা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় গত দুদিন ধরে চলমান গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগ ওই লড়াইয়েরই বহিঃপ্রকাশ- বলছেন লড়াইয়ে অংশ নেয়া রোহিঙ্গা তরুণরা।
তারা বলছেন, ২০১৮ সাল থেকেই এ লড়াই চলছে। আরএসওর ৮৫ সদস্যবিশিষ্ট চার-পাঁচটি সশস্ত্র গ্রুপ এ লড়াইয়ে সক্রিয় রয়েছে। একে-৪৭, এম-১৬ ও গ্রেনেড নিয়েই আরসার বিরুদ্ধে লড়ছে তারা। ওই লড়াইয়ের কারণেই জ্বলছে শূন্যরেখায় রোহিঙ্গাদের বসতি। তবে স্থানীয়রা বলছেন, সংঘর্ষ চলছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে। তবে গোলাগুলি, অগ্নিসংযোগের ওই ঘটনা শূন্যরেখায় হওয়ায় প্রকৃত পরিস্থিতিও জানতে পারছে না বাংলাদেশ। বিজিবি কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের এখতিয়ারের বাইরে হওয়া এ লড়াইয়ের পর থেকেই সীমান্তের ঘুমধুম, তুমব্রু, বাইশারি ফাঁড়ি, কোনারপাড়া, মধ্যমপাড়া এলাকায় টহল জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। এ ছাড়া কড়া নজরদারিতে রয়েছে র্যাব-পুলিশও।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, ঘটনার পর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও অবহিত করেছি। পরবর্তী নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে সীমান্তের ওপারে আরসার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন হামিদুল্লাহ নামে আরএসওর এক সদস্য। ভাগ্যক্রমে একই সময় গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে ফিরেছেন। আজাদের আশায় মত্ত রোহিঙ্গা তরুণ মুহিব উল্লাহ। মুহিব উল্লাহ জানিয়েছেন, নিজেদের অঞ্চলকে `আজাদ` করতেই রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির বিরুদ্ধে লড়ছেন তারা।
রোহিঙ্গা তরুণ মুহিব উল্লাহ বলেন, একে-৪৭, এম-১৬সহ নানা অস্ত্র চালাতে পারদর্শী তিনি। গত বুধবার সকালে তুমব্রু সীমান্তের ওপারে দু`পক্ষের গোলাগুলির সময় তার গায়েও গুলি লাগে। একই সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন হামিদুল্লাহ নামে তার এক সঙ্গী। তারা রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্য। মুহিব উল্লাহ ২০১৮ সালেই আরসার বিরুদ্ধে লড়তে সীমান্তের ওপারে গিয়েছিলেন। গুলিতে আহত হয়ে এখন তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন। তার ডান পাশে বুকের নিচে এবং ডান হাতে গুলি লাগে। বৃহস্পতিবার অস্ত্রোপচার করে বুকের গুলিটি বের করা হয়েছে। তার অবস্থা এখন স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তার হাতেও অস্ত্রোপচার করা হবে বলে গতকাল শুক্রবার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
মুহিব উল্লাহ জানান, ৮৫ জনের একটি দল তাদের জন্মস্থান মিয়ানমারের মংডু অঞ্চল আজাদ করতে গিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। সে থেকেই যুদ্ধ করছেন তারা। বিভিন্ন সময়ই আরসার সঙ্গে তাদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। কখনো সীমান্তে, কখনো সীমান্তের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে। মুহিব উল্লাহ বলেন, তাদের বাড়িই ছিল মিয়ানমারের মংডুতে। ২০১৭ সালে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর মা-বাবা, ভাই-বোনসহ তারা টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে আসেন। জাদিমুরা ক্যাম্পে থাকতেন তারা। তার বাবার নাম দিলদার আহমেদ। চার ভাই এক বোনের মধ্যে তৃতীয় মুহিব উল্লাহ ক্যাম্পে ইংরেজি শিক্ষা নিয়েছেন। ক্যাম্প থেকে চার বছর আগে মিয়ানমারে গিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। মুহিব উল্লাহ বলেন, তারা আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমরা প্রতিশোধ নিতে গিয়েছি। আমাদের ৮৫ জনের দলের সবাই অস্ত্র চালাতে পারেন। আমাদের কাছে একে-৪৭, এম-১৬সহ অনেক অস্ত্র রয়েছে। আমরা মিয়ানমারের জঙ্গলে জঙ্গলে থাকতাম। সেখানেই খাওয়া- দাওয়া হতো। তবে তাদের দলের নেতা কে, কার কথায় যুদ্ধে গেছেন— এসব বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। নিজের দলের নেতাকে না চিনলেও রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহকে চেনেন বলে দাবি করেন মুহিব উল্লাহ। তিনি বলেন, আতাউল্লাহর কথা তিনি শুনেছেন, তবে কখনো দেখা হয়নি। আরসার সঙ্গে কী নিয়ে আরএসওর বিরোধ, তা-ও তিনি জানেন না।
প্রতিশোধপরায়ণ এই রোহিঙ্গা তরুণ বলেন, আরএসওর ৮৫ জনের এই গ্রুপটির মতো আরও তিন-চারটি গ্রুপ রয়েছে। ৮৫ জনের সবার হাতে অস্ত্র থাকে, রয়েছে গ্রেনেডও। মুহিব উল্লাহ বলেন, গত মঙ্গলবার রাত থেকে মিয়ানমারের দিকে গোলাগুলি শুরু হয়। একপর্যায়ে ভোরে আমরা তাদের ঘিরে ফেলি। আমার কাছে ছিল একে-৪৭। ফজরের আজান দেয়ার পর সকাল ৬টার দিকে আমার গায়ে গুলি লাগে। একই সময় হামিদুল্লাহ নামে আমাদের আরেকজন গুলিতে মারা যান।
গুলিতে আহত হওয়ার পর মুহিব উল্লাহকে প্রথমে কুতুপালং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে তার সঙ্গে আছেন তার বোনজামাই শাকিল। শাকিল বলেন, ২০১৭ সালে মংডু থেকে তারা টেকনাফে আসেন। এক বছর পর মুহিব উল্লাহ যুদ্ধ করতে মিয়ানমারে চলে যান। গত বুধবার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাদের খবর দেয়া হয়।
হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, হাসপাতালে আনার পর গতকাল তার অস্ত্রোপচার হয়েছে । তুমব্রু সীমান্তে চলমান এ ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছে সেখানকার মানুষ। ইউএনও রোমেন শর্মা বলেন, শূন্যরেখায় বিজিবিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বাহিনীর হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার নেই। ফলে সেখানকার প্রকৃত পরিস্থিতি জানা যাচ্ছে না। তবে যতটুকু খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে বুধবারের ঘটনায় আশ্রয়শিবিরে প্রায় ৫৫০টি বসতঘর পুড়ে গেছে। ৭০ থেকে ৮০টি ঘর এখনো অক্ষত।
এদিকে রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা দিল মোহাম্মদ জানান, বুধবার গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগের পর রোহিঙ্গাদের বেশ কজন মিয়ানমারে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। হঠাৎ করে উত্তেজনায় সবাই আতঙ্কিত।
ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, বুধবার বিকালে সন্ত্রাসীদের দেয়া আগুনে পুড়ে যায় শূন্যরেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি ঘর। এ সময় নারী- শিশুসহ অনেক রোহিঙ্গা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদে আশ্রয় নেন। পরে তাদের সেখান থেকে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এলাকায় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের কড়া নজরদারি রয়েছে।