আইন সংস্কারের ফলে অদক্ষতা বাড়বে এবং জবাবদিহি কমে যাবে -ম. তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
জনগণের কথা বলার একটা জায়গা ছিল সেটি আর থাকল না -ইজাজ হোসেন, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
আইন করে বিইআরসিকে অকার্যকর করা হয়েছে -এম শামসুল আলম জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, ক্যাব
গ্যাস, বিদ্যুৎ, এলপিজি ও জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের একক ক্ষমতা ছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হাতে। সম্প্রতি আইন সংশোধন করা হয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বিইআরসির। পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন সংশোধন করে বিইআরসিকে অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। এতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ থাকবে, থাকবে না শুধু ক্ষমতা। বিইআরসি এখন পুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে।
গত বছরের ১ ডিসেম্বর জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম সরাসরি বাড়ানো-কমানোর ক্ষমতা সরকারের কাছে আনতে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করা হয় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে। ফলে এখন থেকে গণশুনানি ছাড়াই জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম ঠিক করতে পারবে সরকারও। ফলে বিশেষ প্রয়োজনে যেকোনো সময় সরকার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ, পুনঃনির্ধারণ ও সমন্বয় করতে পারবে। সে হিসেবে ১২ জানুয়ারি ৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে সরকার। ক্ষমতা পাওয়ার পর সরকার এই প্রথম নির্বাহী আদেশে দাম বৃদ্ধি করে নজির সৃষ্টি করেছে। এর আগে বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতে দাম প্রস্তাবনা আসত। ভোক্তার অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণশুনানি হতো। তারপর একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দাম নির্ধারিত হতো। এরপর জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ একইভাবে নির্বাহী আদেশে সরকার গ্যাসের তিনগুণ দাম বৃদ্ধি করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন করে এ খাতে সমস্ত প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা বিনষ্ট করা হয়েছে। মূল্যহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে গণশুনানি থাকায় মানুষের কাছে তা উন্মুক্ত হচ্ছিল। কিভাবে মূল্য বেশি নেয়া হচ্ছে, লুণ্ঠন হচ্ছে সেটা মানুষ জানত। সরকারের হাতে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা নিয়ে যাওয়ায় সেই জায়গাটায় এখন স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। কমিশনের শক্তিমত্তা থাকলেও কাজের ক্ষমতা নেই। সম্প্রতি বিদ্যুতের দাম নিয়ে দেখা দেয় বিরোধ। বিইআরসি গণশুনানির আয়োজন করে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য নির্ধারণের সময় নিচ্ছিল। শুনানি শেষে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে ফলাফল ঘোষণা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে সরকার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। পরে বিইআরসি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়া স্থগিত করতে বাধ্য হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় চেয়েছিল বিইআরসিই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিক। তবে তা ১৫ জানুয়ারির মধ্যে। কিন্তু বিইআরসি চেয়েছিল ৩০ জানুয়ারির মধ্যে আদেশ দিতে। বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি মন্ত্রণালয়। এ জন্য তাদের পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এতে ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা প্রতিক্রিয়ায় বলেন, কমিশনকে উপেক্ষা করে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিইআরসির ওপর অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করা হলো, ক্ষমতা খর্ব করা হলো। ফলে কমিশন অকার্যকর হয়ে গেল। জ্বালানি খাতে অপব্যবহার, অপচয় ও দুর্নীতির বিষয়ে জবাবদিহিতার পথে বাধা সৃষ্টি হলো। এতে অদক্ষতা বাড়বে এবং জবাবদিহিতা কমে যাবে। ইচ্ছামতো দাম বাড়াতেই এটি করা হয়েছে।
তারা বলেন, জ্বালানি খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ২০০৩ সালে বিইআরসি আইন করা হয়। কমিশন শুধু গ্যাস, বিদ্যুৎ ও এলপিজির দাম নির্ধারণ করত। কমিশনের এখতিয়ারে হলেও জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করত সরকার নিজেই।
এ ছাড়া বিইআরসির কাছ থেকে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সরকারি এলপিজির দাম নির্ধারণের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়। জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করত সরকার নিজেই। এদিকে নতুন অধ্যাদেশের ক্ষমতাবলে শুধু বিদ্যুৎ নয়, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যখন খুশি তখন তেল ও গ্যাসের দামও বাড়াতে পারবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, বিইআরসি গণশুনানি করেছে। পরবর্তী পদক্ষেপও তাদের নেয়ার কথা। তা না করে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো হয়েছে। এটি অগ্রহণযোগ্য। অধ্যাদেশ ঢালাওভাবে ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব বিনষ্ট করা গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে বিইআরসির এখতিয়ার পদদলিত করা হয়েছে। জনগণের অর্থে পরিচালিত একটি খাত, সেই খাতে জনগণের নামমাত্র অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কমিশন গণশুনানি করত, সেটিকে পদদলিত করা হলো। এর আগে ১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার শুরু হয়। এ সংস্কারের মধ্যেই ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি করা। সরকারের কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করাই নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাজ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) চাপেই ২০০৩ সালে বিইআরসি আইন করা হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে এটি কার্যকর হতে শুরু করে।
নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) অকার্যকর হয়ে গেল বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ- সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শাসমুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, একটি শক্ত রেগুলেটরি কমিশন গঠন করে এর আওতায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে আনার জন্য আমরা চেষ্টা করছিলাম। এর জন্য ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমরা চেষ্ট করেছি। কিছুটা অগ্রগতিও হয়েছিল। এখন মূল্যবৃদ্ধির ক্ষমতা নিয়ে নেয়া এবং মূল্যবৃদ্ধির ফলে পুরো রেগুলেটরি সিস্টেম সমাহিত হয়ে গেল।
তিনি বলেন, ভোক্তার জ্বালানি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভোক্তার লড়াই করার আইনি সুযোগ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল- তা রাষ্ট্র কেড়ে নিল । এ বিষয়ে আইনের আশ্রয় নেয়ার কথা চিন্তা করছেন না বলেও জানান তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, যারা আইন করে তারাই আবার আইন ভঙ্গ করে। ১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার শুরু হয়। সেই প্রেক্ষিতেই বিইআরসি প্রতিষ্ঠিত হয়। আইন সংস্কারের ফলে অদক্ষতা বাড়বে এবং জবাবদিহি কমে যাবে। ইচ্ছামতো দাম বাড়াতেই মূলত এটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু বিশেষ সময়ে দাম নির্ধারণ করবে সরকার। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। বিশেষ পরিস্থিতির কোনো ব্যাখ্যা নেই। সরকার যেটাকে বিশেষ পরিস্থিতি বলবে, সেটাই বিশেষ পরিস্থিতি হয়ে যাবে। ওইটা আসলেই বিশেষ পরিস্থিতি কি-না, তা যাচাই করার তো সুযোগ নেই। এতে সরকার যখন খুশি তখন দাম বাড়াতে পারবে।
অপর জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, `নির্বাহী আদেশ` সংস্কৃতির মাধ্যমে বিইআরসি অকার্যকার হয়ে পড়ল। এটি দুঃখজনক। স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান থাকলেও কোনো কাজ করতে পারবে বলে মনে হয় না। এটা শুরু এর পর থেকে নির্বাহী আদেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামও বাড়ানোর পথ সুগম হলো।
তিনি আরও বলেন, বিইআরসির কার্যক্রমেই আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম না। তারপরও জনগণের কথা বলার একটা জায়গা ছিল। সেটি আর থাকল না। কাগজে কলমে থাকলেও কার্যকারিতা বাস্তবে দেখা যাবে না।