দেশের দুর্নীতি দমনে কাজ করা একমাত্র আইনি প্রতিষ্ঠান দুদক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই সংস্থার দ্বারস্থ হয়। অভিযোগ পেলে তদন্তে নামে সংস্থাটি। তদন্তে সত্যতা মিললেই মামলা হয়। তবে অতীতে দুদকের মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তিতে গতি বেড়েছে দুদকের। মন্থরতা কাটিয়ে বেড়েছে তৎপরতাও। ফল দিচ্ছে দুদকের ফাঁদ পদ্ধতিও। তাই দুদকের মামলার সাজার হার অনেক বেড়েছে। তবে সাজার হার বাড়লেও কমেছে মামলার সংখ্যা। ২০২১ সালের তুলনায় গত বছরে মামলা কমেছে। আবার যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। চার্জশিট দাখিলে গতি না ফিরলে মামলা নিষ্পত্তিতে আবার বাধা আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, অভিযোগ নিষ্পত্তিতে রেকর্ড, অনুসন্ধান তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা কাটিয়ে দুদক গেল বছর বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। সংস্থাটি শুধু চুনোপুঁটিদে নিয়ে কাজ করে, রুই-কাতলা ধরে না- এমন অভিযোগ থেকেও বেরিয়ে আসছে। শুধু চুনোপুঁটি নয়, দুদকের মামলায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জেলে আছেন। তদন্ত চলছে একাধিক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। দুদকের করা মামলার রায়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যেমন সাজা পেয়েছেন, তেমনি দণ্ড হয়েছে বিদেশি নাগরিকদেরও। করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা জরিমানা।
সূত্রমতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে প্রায় ১৭ হাজারের বেশি। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ৩৫৪টি বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। সে সাথে ৩১২টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি হয়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়ায় দুদক নোটিস জারি করেছে ৮৯টি। অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ২৭৬টি মামলা দায়ের করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি ১৬২টি মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৭৮টি মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ফলে অভিযোগ বাড়লেও কমেছে মামলা-চার্জশিটের সংখ্যা।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৬১ ভাগ ভুক্তভোগী সরাসরি দুদক কার্যালয়ে এসে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। তবে সাত উৎস থেকে আসা এসব অভিযোগের শতকরা ৯৬ ভাগই টেকেনি। তদন্ত শেষে দেখা গেছে এসব অভিযোগের অধিকাংশই মিথ্যা। তাই তদন্ত শেষে প্রমাণ না হওয়ায় মিথ্যা আক্রোশমূলক অভিযোগগুলো তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অনেকে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে বা প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে দুদকে মনগড়া অভিযোগ দেন, যা যাচাই-বাছাই শেষে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ফলে শুরুতেই এসব অভিযোগ বাতিল করে দেয় দুদক। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এমন কাণ্ড চললেও দুদক আইনে মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে মিথ্যা অভিযোগকারীদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না সংস্থাটি। এদিকে এসব মিথ্যা অভিযোগ তদন্তে সময় নষ্ট হচ্ছে দুদকের। খরচ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। তবুও মিথ্যা অভিযোগ কমছে না।
তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ভুয়া অভিযোগকারীকে শাস্তির আওতায় আনা দরকার। আইনে এ বিধানটি যুক্ত করার দাবি জানান তারা। দ্রুতই আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমিশনে যেসব মানুষ অভিযোগ জমা দেন, তারা সংস্থাটির তফসিলভুক্ত অপরাধের বিষয়ে সচেতন নন। যে কোনো অভিযোগ হলেই লিখিত আকারে কমিশনে জমা দেয়া হয়। অনেকে অভিযোগ লেখার ক্ষেত্রেও ভুল করেন। কেউ কেউ তফসিলভুক্ত অপরাধের বিষয়ে জানালেও শুধু অভিযোগ লেখার ধরন ঠিক না হওয়ার কারণে তা আমলে নেয়া যায় না।
দুদকের মামলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে কমিশনের তিন হাজার ৩২৬টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে পাঁচ বছরের অধিক সময় বিচারাধীন— এমন মামলাও রয়েছে। বিচারাধীন মামলার মধ্যে বর্তমানে দুই হাজার ৯১০টি মামলার বিচারকাজ চলছে।
এছাড়া উচ্চ আদালতের আদেশে ৪১৬টি মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত আছে। উচ্চ আদালতে ৬২৪টি রিট, ৭৯৩টি ফৌজদারি, এক হাজার আটটি আপিল মামলা এবং ৫১৩টি রিভিশন মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। দুদক প্রসিকিউশনের চেষ্টায় ৪৯টি মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছেন আদালত। যেগুলো দ্রুতই নিয়মিত মামলা হিসেবে শুনানি হবে।
এদিকে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রায় হওয়া ৩৪৬ মামলায় সাজার হার প্রায় ৬০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। যেখানে অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৯টি মামলার রায়ে সাজা হয়েছে ৪৯টিতে। একই সময়ে সংস্থাটি মোট জরিমানা করেছে ৪১ কোটি ৭৮ লাখ ২৮ হাজার ২০৬ টাকা। এ সময় আট কোটি ২৭ লাখ ৭৫ হাজার ৯৭১ টাকা মূল্যের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে দিন দিন দুদকের তৎপরতা বাড়ায় সামনে মামলার রায় ও সাজার হার আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে দুদকের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান বলেন, মামলা নিষ্পত্তিতে গতি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। রায় এবং সাজার হারও অনেকে বেড়েছে। ভবিষ্যতে সাজার হার আরও বাড়বে। যেসব মামলা স্থগিত আছে, সেটা কী জন্য স্থগিত আছে, সেসব কারণ খুঁজে বের করতে আমরা কাজ করছি। আশা করছি দ্রুতই স্থগিত মামলাগুলো সচল হবে।
জানা যায়, গত বছর রায় হওয়া ৩৪৬ মামলায় সাজার হার ৬০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এর মধ্যে `দুর্নীতি দমন কমিশনের` মামলায় সাজার হার ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ আর আগের বিলুপ্ত `দুর্নীতি দমন ব্যুরোর` মামলায় সাজার হার ৩৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। রায় হওয়া এসব মামলায় সাজা হয়েছে ২১১টি (কমিশনের ১৯৭ ও ব্যুরোর ১৪)। খালাস হয়েছে ৯৪টি (কমিশনের ৮১ ও ব্যুরোর ১৩) এবং অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৪১টি (কমিশনের ২৯ ও ব্যুরোর ১২) মামলা।