গ্যাস সংকটে বাড়ছে খরচ

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৩, ১২:৫৪ এএম

বর্তমান পরিস্থিতির আপাতত উন্নতির সম্ভাবনা নেই, এ ছাড়া সমস্যার দ্রুত সমাধানও নেই -বদরুল ইমাম, জ্বালানি ও ভূতত্ত্ববিদ

  • চুলায় গ্যাস নেই তবুও প্রতি মাসেই গুনতে হচ্ছে বিল
  • বিকল্প ইলেকট্রিক চুলা-প্রেসারকুকার সিলিন্ডার গ্যাস
  • অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা

চুলায় গ্যাস নেই। ভরসা এখন বৈদ্যুতিক চুলা ও এলপি গ্যাস। রাজধানীসহ সারা দেশে একই চিত্র। কোথাও কোথাও মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত গ্যাস মিললেও রান্নার সুযোগ পান না অনেক গৃহিণী। মধ্য রাতের গ্যাসের কারণে নগরীর বাসাবাড়িতে পরিবর্তন হয়েছে রান্নার রুটিন। প্রাত্যহিক রুটিনেও এসেছে পরিবর্তন। এদিকে চুলায় গ্যাস না থাকলেও প্রতি মাসে গ্রাহকে এক চুলার জন্য ৯৯০ ও দুই চুলার জন্য এক হাজার ৮০ টাকা গুনতে হয়। এমনকি বহু ভবনে গ্যাসের লাইন রয়েছে কিন্তু অফিস বা বাণিজ্যিক স্পেস হওয়ায় ব্যবহার হচ্ছে না গ্যাস। তবুও দিতে হয় গ্যাসের বিল। এভাবে যুগের পর যুগ বিল দিয়ে যাচ্ছেন বহু বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া।

অন্যদিকে চুলায় গ্যাস না থাকায় বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রিক চুলা, প্রেসার কুকার, রাইস কুকার ও এলপি গ্যাসের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ যেন ‍‍`গোদের ওপর বিষফোঁড়া‍‍`। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের কপালে এমনিতেই চিন্তার ভাঁজ, তার মধ্যে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। গত বছর জুনে আবাসিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। মধ্য, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের সংসার চালাতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত সেখানে খাবার রান্নার করার জন্য অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয়।

ভোক্তা অধিকার-সংক্রান্ত সংস্থাগুলো বলছে- টাকা দিয়েও গ্যাস না পাওয়া চরম দুঃখজনক। এটি ভোক্তার ওপর অন্যায্যভাবে বাড়তি অর্থ চাপিয়ে দেয়ার শামিল। এতে গ্রাহকের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। রাজধানীর গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা কামরুন্নাহার চাকরি করেন ব্যাংকে। তাই সাতসকালেই তার দিনের রান্নার কাজ শেষ করতে হয়। গত দু‍‍`মাস থেকে তার এই রুটিন পাল্টে গেছে। আগের দিন রাতেই পরের দিনের সব রান্না শেষ করতে হয়। এরপর ভোরে উঠে তাড়াতাড়ি রাতের রান্নাগুলো গরম করতে হয়। কারণ সকাল ৭টার পরই চুলা জ্বলে না।

শুধু গেন্ডারিয়া নয়, রাজধানীর প্রায় সব এলাকার একই চিত্র। সম্প্রতি রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার বসতবাড়ির চিত্র এটি। তবে সমার্থ্যবানরা বিকল্প চুলার আশ্রয় নিলেও চরম ভোগান্তিতে পড়ে মধ্য ও নিম্নবিত্ত। আবাসিকের পাশাপাশি কল- কারখানা, সিএনজি স্টেশন, হোটেল- রেস্টুরেন্ট, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সব খাতেই ভয়াবহ গ্যাস সংকট চলছে। সিএনজি স্টেশনসহ বিভিন্ন খাতে গ্যাস রেশনিং করেও পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না জ্বালানি বিভাগ।

কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা ও ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. সাইদুল ইসলাম আমার সংবাদকে জানান, তার এলাকায় রাত ১টায় গ্যাস আসে আবার ভোর ৬টা চলে যায়।

তিনি বলেন, বাসায় রান্না করতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় প্রতিনিয়ত। যাত্রাবাড়ীর রসূলপুরের বাসিন্দা মারুফ হাসান জানান, কয়েক মাস আগে থেকেই চুলায় গ্যাস পাওয়া যায় না। রান্নাবান্নায় দেখা দিলো বিপত্তি। এ জন্য তিনি বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাসের ব্যবস্থা করেছেন। এতে তার অতিরিক্ত দেড় থেকে দুই হাজার টাকা খরচ গুনতে হয়। এ ছাড়া অনেকেই ইলেকট্রিক চুলায় ঝুঁকছেন।

ডেমরা এলাকা থেকে মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, মাঝ রাতে চুলায় গ্যাস আসতে শুরু করে। তখন আর রান্নার সুযোগ থাকে না। তিনি বলেন, খুব ভোরে ওঠে রান্নার কাজ সারেন মা। এতে অনেক ভোগান্তি আর কষ্ট সহ্য করতে হয়। আগে আমরা সকালে বাজার সদাই করতাম সকালে রান্না হতো। কিন্তু এখন রাতেই কাঁচাবাজার কিনে রাখতে হয়। ফলে আমরা তাজা শবজি আগের মতো পাই না। এতে আমাদের দৈনন্দিনের রুটিনও পরিবর্তন হয়েছে।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মিরপুর, ধানমন্ডি, হাতিরপুল, পুরান ঢাকা, শ্যাওড়াসহ বেশির ভাগ এলাকাতেই অধিকাংশ সময় চুলা জ্বলছে না। গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ শিল্পকারখানা দিনের বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে।

শিল্পকারখানার মালিকরা বলছেন, লাইনে গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই (প্রেসার পার স্কয়ার ইঞ্চি) থাকার কথা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে তিন-চার পিএসআই। এতে কারখানা চালু রাখা সম্ভব হয় নয়। বেশির ভাগ সময়ই শ্রমিকরা অলস সময় কাটান। দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এ অবস্থা। সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদনে না থাকায় তারা আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে পোশাক, টেক্সটাইল কারখানাগুলোর সংকট চরম আকার নিয়েছে।

শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও সমাধান মিলছে না। এ কারণে আদেশ বাতিলের আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, দ্রুত গ্যাস সংকটের সমাধান না হলে সার্বিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪৫০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। বছর খানেক আগেও ৩৩০ থেকে ৩৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিত পেট্রোবাংলা।

সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে গেছে। কমেছে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানিও। তাই সংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। নবীনগরের বাসিন্দা মুর্শিদা বেগম। তিনি বাসাবাড়িতে কাজ করেন। দুটি মেসে রান্নার কাজ করেন। গ্যাসের তীব্র সংকটে বেগ পোহাতে হয় তাকে। তিনি ভোর ৪টায় এক মেসে কাজ শুরু করেন। সেখানে কাজ শেষ করে ৬টায় অন্য মেসে কাজ শুরু করেন। কিছু অর্থের আশায় তাকে শীতের মধ্যেই এই কাজ করে যেতে হচ্ছে। গ্যাস মিলছে না সিএনজি স্টেশনেও।

সিএনজি স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ফারহান নূর বলেন, লাইনে একদম প্রেসার নেই। ১৫ পিএসআইর জায়গায় দুই-তিন পিএসআই চাপ মিলছে।

তিনি আরও জানান, তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে, যার পাশেই দেশের অন্যতম বড় গ্যাসক্ষেত্র তিতাস অবস্থিত। সোর্সের পাশে থেকেও শহরে গ্যাস মিলছে না, এটি কখনো হয়নি।

সূত্র মতে, গ্যাস সংকটে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। গ্যাসভিত্তিক সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হয়। তবে ঘাটতির কারণে পেট্রোবাংলা সর্বোচ্চ ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিতে পারে। এই সরবরাহও এখন ৭০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমারা এখন কারখানা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রধিকার দিতে চাই। বাসাবাড়িতে তো বিকল্প হিসেবে এলাপি গ্যাসের ব্যবস্থা আছেই। শিল্প উৎপাদন কমে গেছে দেশের অর্থ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে তাদের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৯০ কোটি ঘনফুট, বিপরীতে পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ১৭০ কোটি ঘনফুট। আরেক কর্মকর্তা জানান, জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে।

পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, সরকারের নানা উদ্যোগে কয়েক বছর আগে দেশের দৈনিক গ্যাস উৎপাদন বেড়ে ২৭০ কোটি ঘনফুটে পৌঁছেছিল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশেষ করে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অচলাবস্থার কারণে বর্তমানে তা কমে ২৩০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি আছে, এটি ঠিক। সারা বিশ্বেই গ্যাসের সমস্যা এখন। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে।

তিনি বলেন, দাম সহনীয় হলে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কথা ভাবতে পারে সরকার। এখন দেশি উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম আমার সংবাদকে বলেন, বিশ্ববাজারে এলএনজির চাহিদা বাড়ছে। তিনি বলেন, অবশেষে সরকার দেশে উৎপাদন বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে, যা পাঁচ বছর আগেই করা উচিত ছিল। তবে রাতারাতি গ্যাস পাওয়া যাবে না। আমদানিনির্ভরতা ভুল নীতি ছিল। তাই এখন ভুগতেই হবে, এটি কৃতকর্মের ফল। তাই পরিস্থিতির আপাতত উন্নতির সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া সমস্যার দ্রুত সমাধানও নেই।