কিছুদিন আগেও বিচারব্যবস্থা সেকেলে ছিল। রায় ও মামলার তথ্য জানতে হলে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো। মাসের পর মাস ঘুরেও আদেশের কপি হাতে পাওয়া মুশকিল ছিল। যেন ভোগান্তির শেষ ছিল না। এতে যেমন বিপুল পরিমাণ টাকা-পয়সা খরচ হতো, তেমনি নষ্ট হতো মূল্যবান সময়ও। বিচারসংশ্লিষ্টদের সেবা নিয়েও নানা অভিযোগ ছিল।
বিচারক রায়ে কী বলেছেন, সেটি জানতে ও রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আপিল করতে দরকার পড়ে নকল। এ কপি পেতে দিনের পর দিন আইনজীবীদের পিছে ঘুরতে হতো বিচারপ্রার্থীদের। আর পরিস্থিতির ফাঁদে ফেলে ভুক্তভোগী মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিতেন আইনজীবীরা। দেশের সব আদালতের চিত্র যেন এমনই। অথচ সরকারি হিসাবে এক পৃষ্ঠার আদেশের নকল তুলতে খরচ পড়ে মাত্র ৪৯ টাকা।
তবে সময় বদলেছে। সেকেলে পদ্ধতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে বিচারবিভাগ। বাড়ছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্ট অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আশা তৈরি হচ্ছে। বিচারিক আদালতের রায় ও আদেশ অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।
এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় ও আদেশের অনুলিপি সহজ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত হচ্ছে। ফলে বিচারপ্রার্থী সহজেই মামলার নকল ও সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করতে পারছেন। এতে ভোগান্তি কমেছে। এদিকে সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও আদেশ অনলাইনে পাওয়া গেলেও অনলাইনে নিম্ন আদালতের কোনো বিচারকের রায় প্রকাশের ঘটনা এটিই প্রথম বলে জানান আইনজীবীরা।
রাসেল দেওয়ান। বাড়ি ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়া এলাকায়। পৈতৃক সম্পত্তির রেকর্ড সংশোধন নিয়ে প্রতিবেশী উজ্জল দেওয়ানের সাথে প্রায় দেড়যুগ ধরে মামলা চলছে। মামলাটি ঢাকার সহকারী জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল। প্রায় চার মাস আগে মামলার রায় পেলেও রায়ের কপি তুলতে দীর্ঘ সময় কেটে গেছে। রায়ের সার্টিফায়েড কপি তুলতে মাস দেড়েক আদালতে ঘুরেছেন রাসেল। টাকা খরচ করেও তুলতে পারেননি। তবে সম্প্রতি বিচারিক আদালতে অনলাইনে রায়ের কপি পাওয়া যাচ্ছে শুনে আইনজীবীর সহায়তা নেন রাসেল। পরে অনলাইন থেকেই রায়ের সত্যায়িত কপি সংগ্রহ করেন তিনি।
শুধু রাসেল দেওয়ানই নয়, বিভিন্ন মামলার বাদী-বিবাদীদের দিনের পর দিন ঘুরতে হয় আদালতের বারান্দায়। মাস, বছর এমনকি যুগ পেরোলেও অনেকে নথির কূল- কিনারা পান না। অথচ এখন তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অনলাইনে বাদী বা বিবাদীপক্ষ চাইলে ঘরে বসেই পেতে পারেন সংশ্লিষ্ট মামলার তথ্য। এজন্য আদালতের বারান্দায় ঘোরা বা অতিরিক্ত টাকা খরচেরও প্রয়োজন নেই।
তবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই ডিজিটাল সেবার আওতায় কতটা আসতে পেরেছে তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এখন সুযোগ আছে দেশ-বিদেশের যেকোনো স্থানে বসে বিচারিক আদালতের রায় বা আদেশের অনুলিপি সংগ্রহের। অধস্তন আদালতের গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি মামলা, যেমন হত্যা, ধর্ষণ, সাইবার অপরাধসহ জমি-জমা ও পারিবারিক বিরোধ সংক্রান্ত নানাবিধ দেওয়ানি মূল ও আপিল মামলার রায়ের অসংখ্য কপি আপলোড করা হচ্ছে, যা যে কেউ অনলাইনে নিজের সুবিধামত তা দেখতে পাচ্ছেন।
সারা দেশের আদালতের রায় ও গুরুত্বপূর্ণ আদেশ এই অ্যাপসে আপলোড করা হচ্ছে। এতে ঘরে বসেই মামলার সব পক্ষসহ যে কেউ ওই রায় দেখতে পাচ্ছেন। রায়গুলো বাংলা-ইংরেজিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় পড়া যাচ্ছে । তবে সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এ রায়ের নকল সংগ্রহ করতে হবে।
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিচারক কাজে সংকট, মামলার আধিক্য, মামলার প্রতিবেদন দেরিতে আসা, অভিযোগপত্রে নারাজি, আসামিপক্ষের বারবার সময় আবেদন, উচ্চ আদালতে মামলা স্থগিত রাখা, সময়মতো সাক্ষীদের হাজির করতে না পারা, মামলা নিষ্পত্তিতে আইনজীবীদের গাফিলতিসহ বিভিন্ন কারণে বহু মামলা বছরের পর বছর আদালতে ঝুলে আছে। এতে বাদী-বিবাদীরা আর্থিকভাবে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আদালতে ঘুরে ততটাই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এ অবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নেন প্রধান বিচারপতি।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর ছয়টি কোর্ট প্রযুক্তি উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এর মধ্যে রয়েছে `সুপ্রিম কোর্ট মোবাইল অ্যাপ`, ‘মনিটরিং কমিটির অনলাইন রিপোর্টিং টুলস`, `আপিল বিভাগের ডিজিটাল অনুলিপি শাখা`, `আপিল বিভাগের প্রবেশ পাস`, `অনলাইনে অধস্তন আদালতের রায় ও আদেশ প্রকাশ` এবং `শিশু আদালতের রিপোর্ট এন্ট্রি প্ল্যাটফর্ম` নামে ছয়টি কোর্ট প্রযুক্তির উদ্বোধন করে। প্রধান বিচারপতির অ্যাপস উদ্বোধনের পর থেকে এরই মধ্যে এক হাজার ৮৭৫টি রায় ও গুরুত্বপূর্ণ আদেশ আপলোড করা হয়েছে ওয়েবসাইটে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে দেওয়ানি আদালতের ৪৩৭, ফৌজদারি আদালতের এক হাজার ৩৬৫ এবং পারিবারিক আদালতের ৭৩টি।
বিচারিক আদালতের আদেশ ও রায় ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার জন্য প্রধান বিচারপতির পরামর্শে গত বছরের ২০ নভেম্বর আরও একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। নির্দেশনা দেয়ার পর থেকে এরই আলোকে `অধস্তন আদালতের রায় ও আদেশ` নামে একটি ওয়েবসাইট প্রস্তুত রয়েছে। যেখানে ২০ নভেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৩০০ এর বেশি রায় ও আদেশের কপি প্রকাশ করা হয়েছে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নিম্ন আদালতের আদেশ ও রায় অনলাইনে প্রকাশ করা হলে বিচারকার্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং আদালত কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা ক্রমান্বয়ে বাড়বে। এছাড়াও মানসম্মত ন্যায়বিচার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও টেকসই উন্নয়নে তা বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
বিশেষত, বিচারিক সেবাপ্রাপ্তিতে ব্যয়বহুলতা ও দুর্ভোগ লাঘব করে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষের দোরগোড়ায়ও বিচারের বাণী দ্রুত পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার ও মুখপাত্র মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বলেন, বিচারপ্রার্থীকে আর রায়ের জন্য আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে না। তিনি চাইলে এমনকি মোবাইল ফোনে তার রায় বা আদেশ দেখে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। রায় বা আদেশের নকল পেতে আগে যে সময় ব্যয় হতো, এখন এর চেয়ে অনেক কম সময়ে তা সংগ্রহ করা যাচ্ছে। নতুন এই উদ্যোগে বিচারকাজে গতি আসবে এবং মামলা নিষ্পত্তি বাড়বে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, বিচারিক আদালতে সমস্যার শেষ নেই। রায়ের কপি, মামলার নথি, আরজি পেতে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। তবে বর্তমানে আদালতের রায় অনলাইনে পাওয়া বিচার বিভাগের জন্য বিশাল অগ্রগতি। বলতে পারেন একটা মাইলফলক। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এখন যেহেতু সবাই দেখতে পারছেন, এতে স্বচ্ছতা বাড়বে। আগে যেকোনো মামলার রায় হওয়ার পর অনেক প্রসেস মেইনটেন করে পেতে যে সময় লাগতো এখন কিন্তু তা লাগছে না। এখন দ্রুতই রায়ের বিস্তারিত জানতে পারছেন বিচারপ্রার্থীরা।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. ফিরোজুর রহমান মন্টু বলেন, জাজমেন্ট করার পর যদি অনলাইনে এটা প্রচার করা হয়। তাহলে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় এটা পৌঁছাবে। এতে মানুষ বুঝতে পারবে আইনে কী করলে কী হয়।