প্রতিবন্ধীরা ভালো নেই। সমাজের দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়েই তাদের বেঁচে থাকতে হয়। সামাজিক ও পারিবারিক অবহেলা যেন নিত্যসঙ্গী। প্রতিবেশীরাও ভিন্ন চোখে দেখেন। তাদের মতামত, সুখ-দুঃখের কথা শোনা বা দেখার কেউ নেই। অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার লোক থাকে না। অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি হলেও সঠিক চিকিৎসা পান না। সমাজে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েই জীবন পার করেন প্রতিবন্ধীরা। যে বঞ্চনার শুরু আছে, শেষ নেই।
তবে প্রতিবন্ধীদের মধ্যেও কেউ কেউ অদম্য মেধাবী। লেখাপড়ায় আলো ছড়াচ্ছেন। কিন্তু অনেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও বেকার বসে আছেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেও চাকরি মিলছে না। সরকারি-বেসরকারি চাকরির পরীক্ষায় মেধা তালিকায় জায়গা পেয়েও চাকরি পাচ্ছেন না। সমস্যা একটাই— তারা প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধীদের কেউ জায়গা দিতে চান না।
সরকারি চাকরিতে চূড়ান্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য কোটা পূরণ করা হলেও প্রতিবন্ধী কোটা পূরণ করা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ চেষ্টা ও আশ্বাসের পরও অদৃশ্য কারণেই অবহেলিত থেকেন যাচ্ছে প্রতিবন্ধীরা। তাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রীকন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। প্রতিবন্ধীদের কোটা বরাদ্দের কথা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর বাস্তবায়ন নেই। প্রতিবন্ধীরা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেও চাকরি পান না। এমনকি মেধাতালিকায় জায়গা পেয়েও চূড়ান্ত নিয়োগে বাদ পড়ছেন- এমন অনেক নজির রয়েছে।
এবার এমনই কজন প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থীর গল্প শোনাব, যারা দেশের বিভিন্ন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েও চাকরি পাননি। এদের মধ্যে একজন মো. মাহবুব শেখ। বাড়ি গাইবান্ধা জেলায়। জন্ম থেকেই চোখে আলো নেই মাহবুবের। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাহবুব লেখাপড়ায় ঠিকই আলো ছড়িয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। স্নাতকোত্তর শেষ করেই প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী শিক্ষক পদে পরীক্ষা দেন তিনি। তবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেও চাকরি পাননি মাহবুব। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় কোনো কারণ ছাড়াই চূড়ান্ত নিয়োগে তাকে বাদ দেয়া হয়।
বাগেরহাটের পার্থ প্রতিম মিস্ত্রী। জন্ম থেকেই তিনি অন্ধ। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও লেখাপড়ায় বেশ ভালো ফল করেছেন তিনি। কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী শিক্ষক পদে পরীক্ষা দেন পার্থ। কিন্তু লিখিত ও ভাইভাতে পাস করেও নিয়োগ পাননি। চোখে দেখতে পারেন না- এই অজুহাতে চূড়ান্ত নিয়োগে তাকে রাখা হয়নি । চাকরি পেতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও কাজ হয়নি।
ছোটবেলা থেকেই সংগ্রামী জীবন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পারুল বেগমের। ঢাকার পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জ থেকেই নিয়মিত ঢাকায় এসে লেখাপড়া করেছেন। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বেশ কবার সরকারি চাকরির চেষ্টা করেও কাজ হয়নি। সবশেষ প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় সরকার। এতে আবেদন করেন পারুল। তবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেও নিয়োগ পাননি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় চূড়ান্ত নিয়োগে তাকে বাদ দিয়ে কোটা খালি রেখেই নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়।
মো. রেজওয়ান হোসেন। বাড়ি লালমনিরহাটে। মেধাবী রেজওয়ান শারীরিক প্রতিবন্ধী। সমাজের আর দশজন মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবে চলতে পারেন না তিনি। তবুও হাল ছাড়েননি। অদম্য মেধাবী রেজওয়ান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। চাকরির জন্য অনেক ছুটেছেন। তবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় ভাগ্য তার সহায় হয়নি। প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে লিখিত পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান করে মৌখিক পরীক্ষায়ও পাস করেন রেজওয়ান। তবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে চূড়ান্ত নিয়োগ থেকে বাদ দেয়া হয়।
শুধু এ চারজনই নন, চাকরি না পাওয়া এমন সংক্ষুব্ধ ২৫০ প্রতিবন্ধী এবার নিয়োগ পেতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। তারা ২০২০ সালে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ পাননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তর পরিদপ্তরে ঘুরেও কাজ হয়নি। পরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সিদ্দিক উল্যাহ মিয়ার সহায়তায় হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগে প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য ১১৪টি পদ সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে প্রতিবন্ধী কোটায় কেন তাদের নিয়োগ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পরও মূলধারার অর্থনীতিতে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ নেই। ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১০ থেকে ১৫ ভাগই প্রতিবন্ধী। তেমনই একজন রাসেল ঢালী। বাড়ি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায়। জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী রাসেল। ঠিকমত চলাফেরা করতে পারেন না। চাকরি পেয়েও নিয়োগপত্র পাননি রাসেল। চাকরি নামক সোনার হরিণ অধরাই থেকে যাচ্ছিল রাসেলের। কিন্তু চাকরি ফিরে পেতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সিদ্দিক উল্যাহ মিয়ার দ্বারস্থ হন রাসেল। পরে এই আইনজীবীর আইনি লড়াইয়ে ভাগ্য খোলে রাসেলের। হাইকোর্টের রায়ে চাকরি পান রাসেল।
শুধু রাসেল ঢালীই নন, প্রতিবন্ধীদের পাশে থাকতে বরাবরই ইচ্ছা পোষণ করেন সিদ্দিক উল্যাহ মিয়া। বিনা ফিতে দিতে চান আইনি সহায়তাও। এর মাঝে বিনা খরচায় আইনি সেবা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এ আইনজীবী। প্রতিবন্ধীদের প্রতি সদয় দৃষ্টির কারণে তিনি দেশব্যাপী ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিদ্দিক উল্যাহ মিয়া শুধু প্রতিবন্ধী চাকরি প্রার্থীদেরই আশার আলো দেখান না। তিনি দেশের হাজারো চাকরিবঞ্চিতদের শেষ ভরসাস্থল। আস্থার প্রতীক। যে কোনো চাকরিতে অধিকার বৈষম্যে সব সময় পাশে দাঁড়ান তিনি। এজন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়তই সরকারি-বেসরকারি চাকরিপ্রত্যাশীরা তার কাছে আসছেন। পরীক্ষায় পাস করেও নিয়োগবঞ্চিতদের আশার আলো দেখান সিদ্দিক উল্যাহ মিয়া। প্রয়োজনে আইনি সেবা নিয়ে পাশে দাঁড়ান। কখনো কখনো পারিশ্রমিক ছাড়াই মামলায় লড়েন । নিজ খরচে দরিদ্র চাকরিপ্রত্যাশীদের যাতায়াতের ব্যবস্থাও করে থাকেন। এজন্য তিনি `গরিবের আইনজীবী` উপাধীও পেয়েছেন। সিদ্দিক উল্যাহ আইন পেশায় এসেছেন খুব বেশিদিন হয়নি।
তবে অল্পদিনেই আইনি দক্ষতা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। চাকরি-সংক্রান্ত (সার্ভিস ম্যাটার) মামলায় একাধিক রায় পেয়ে দেশজুড়ে আলোচনায় এসেছেন। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কঠিন মামলা জিতে কম বয়সেই অনেক সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার সফলতার গল্প ছড়িয়ে গেছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। বয়সের মাপকাঠি দিয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতার বিচার করা যে ভুল, সেটা গত কয়েক বছরেই প্রমাণ করেছেন এ আইনজীবী। তার বুদ্ধিদীপ্ত আইনি লড়াইয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষা, বিসিএস ক্যাডার, বিভিন্ন নন-ক্যাডার, বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য চাকরিপ্রার্থীর ভাগ্য বদলেছে। হাজারো পথহারা যুবক বেকারত্বের বোঝা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
একজন প্রতিবন্ধী নারী বলেন, `আমি যেন একটু ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারি, সেজন্য এখানে এসেছি। আমি হাঁটতে পারি না। আমার বাবা-মা নেই। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি। অনেক প্রতিষ্ঠানের দরজায় ঘুরেছি কিন্তু কেউ চাকরি দেয়নি।
জানতে চাওয়া হলে অ্যাডভোকেট সিদ্দিক উল্যাহ মিয়া বলেন, সরকার কর্তৃক কোটা পদ্ধতি চালু থাকার পরও কেন প্রতিবন্ধী কোটা পূরণ হচ্ছে না- সেটি বোধগম্য নয়। আমি চাই দেশের সব প্রতিবন্ধী তাদের ন্যায্য অধিকার ভোগ করুক। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তাদের নিয়োগ দিয়ে ভালোভাবে জীবনযাপনের সুযোগ দেয়া হোক। আমি প্রতিবন্ধীদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করব। শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিই নয়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যে কোনো সমস্যায় আইনি সহায়তা দিতে চাই। এক্ষেত্রে আমার কোনো ধরনের পারিশ্রমিক লাগবে না।