চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ

বছরব্যাপী আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা

মো. নাঈমুল হক প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩, ০১:২৮ এএম

এখন তো পরিস্থিতি উত্তপ্ত, আমরা কয়েকদিন পরই ব্যবস্থা নেবো -প্রফেসর মো. মোজাহেদুল ইসলাম অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম কলেজ
ওরা ছাত্র, চাইলেও ওদের বিষয়ে বড় অ্যাকশন নেয়া যায় না -(ওসি) মনজুর কাদের মজুমদার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানা
শিগগিরই এ ব্যাপারে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে -রাকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি

মেধাবীদের এক সময়ের পরিচিত ক্যাম্পাস ছিল চট্টগ্রাম কলেজ। বর্তমানে এখানে হানাহানি-মারামারি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত একবছরেই কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারির অন্তঃকোন্দলে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কারণে-অকারণে শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা চলে সমানতালে। 

সর্বশেষ গত ২৬ জানুয়ারি কলেজের সরস্বতী পূজার দিনেও দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় বহিরাগতদের সঙ্গে কলেজের নেতাদের। এর দুদিন পর ২৯ জানুয়ারি ফের সংঘর্ষে জড়ায় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম ও সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজের অনুসারীরা।

এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। আতঙ্কে আশপাশের ছয়টি ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা। ফলে ইমেজ সংকটে পড়েছে চট্টগ্রামের মেধাবীদের শীর্ষ শিক্ষাস্থল হিসেবে পরিচিত শত বছরের চট্টগ্রাম কলেজ। এ বিষয়ে নীরব ভূমিকায় পুলিশ ও কলেজ প্রশাসন। কেন্দ্রিয় ও নগর ছাত্রলীগের ব্যবহারও দায়সারা। 

কলেজ ছাত্রলীগ বলছে, সব সংঘর্ষের পেছনে আমরা দায়ী নই। আমাদের মধ্যে কিছু ভুল বুঝাবুঝির কারণে এমনটি হয়েছে। আগামীতে আমরা আরও সতর্ক থাকব।

গত বছর অন্তত অর্ধশতাধিকেরও বেশি ছোট-বড় মারামারিতে জড়িয়েছে কলেজটির বিবাদমান দুই গ্রুপ। কলেজকেন্দ্রিক আধিপত্য, ক্ষমতা প্রদর্শন ছাড়াও হাস্যকর ছোট বিষয়েও মারামারি করেন তারা। ‘পান থেকে চুন খসার’ আগেই কলেজ শিক্ষার্থীদের শরীর থেকে ঝরে রক্ত। বিভাগের পিকনিক, প্রেমিকাবিষয়ক ঝামেলা, সালাম না দেয়ার মতো অপরাধের কারণেও মারামারি করেন। এমনকি কলেজের ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নাস্তার ভাগাভাগি ও বক্তব্য প্রদানকে কেন্দ্র করেও মারামারি করতে দেখা যায় নেতাদের। 

গত রোববার (২৯ জানুয়ারি) পরিসংখ্যান বিভাগের পিকনিকের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অনুসারীদের। সংঘর্ষে রক্ত ঝরিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুজন। এর দুদিন আগেও সরস্বতী পূজার দিন সংঘর্ষে মাথা ফেটে হাসপাতালে যেতে হয় কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীকে। 

এছাড়াও সংঘর্ষে প্রভাব পড়ছে আশপাশের ছয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। চট্টগ্রাম কলেজের আশপাশে অল্প দূরত্বে রয়েছে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, কাজেম আলী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরকারি মহসিন স্কুল, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়সহ আরও একাধিক নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম কলেজে সংঘর্ষের প্রভাব পড়ছে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ওপর। মারামারিতে যান চলাচল বন্ধসহ আতঙ্কে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। 

কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আনাস আহমেদ বলেন, কয়েকদিন পরপর ক্যাম্পাসে এমন পরিস্থিতিতে আমরা আতঙ্কে আছি। সংঘর্ষ হলে তো ক্যাম্পাসে থাকা যায় না। কখন কে মেরে দেয়, এ নিয়ে ভয়ে থাকতে হয়। 

মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ফারিয়া আক্তার বলেন, কলেজে আমরা আসি পড়াশোনা করার জন্য। নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে? এগুলো দ্রুত বন্ধ করা প্রয়োজন। 

চকবাজার এলাকার স্থানীয় অভিভাবক নুরুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক বাবা- মায়ের প্রত্যাশা থাকে সন্তানদের নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করানোর। কিন্তু কলেজে কয়দিন পরই এমন ঝামেলা থাকলে সন্তানদের কেমনে পাঠাব? 

চট্টগ্রাম কলেজে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আব্দুল মোতালেব বলেন, 'রাজনীতি থাকুক বা না থাকুক, তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে শিক্ষার পরিবেশ কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। যেখানে ছাত্রলীগের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করবে, সেখানে ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে পড়ালেখার পরিবেশ শেষ করছে। আমরা এমন ছাত্ররাজনীতি চাই না। এখন মেয়েকে কলেজে পাঠাতে ভয় হয়, আতঙ্কে থাকি; কখন কি হয়ে যায়।' 

বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ালেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি কলেজ প্রশাসনকে। শুধুমাত্র সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে 'ব্যবস্থা নেয়া হবে' বলা ছাড়া আর কোনো কিছুর হদিস মেলেনি এখনও। 

এক বছরে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের বিষয়টি স্বীকার করে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মোজাহেদুল ইসলাম বলেন, 'আসলে মারামারি হচ্ছে, তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই।' 

পিকনিক নিয়ে ও সরস্বতী পূজায় মারামারির বিষয়ে তিনি বলেন, 'ওগুলো এখনও গরম-গরম ইস্যুতো, তাই কদিন পর ব্যবস্থা নেবো।' 

আগের ইস্যুগুলোতে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আসলে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, আমরা চাইলেও সবকিছু করতে পারি না। তবে আমরা তাদের ডেকে বুঝিয়ে মিলমিশ করিয়ে দিই। যাতে পরবর্তীতে এগুলো আর না করে। ওদের আমরা নিয়মিত কাউন্সিলিং করি।' 

একই সুরে কথা বলেছেন চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুর কাদের মজুমদার। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ওরা ছাত্র, তাই চাইলেও ওদের বিষয়ে বড় অ্যাকশন নেয়া যায় না। দুগ্রুপের নেতাদের ডেকে কাউন্সিলিং করছি, কলেজ প্রশাসনকেও বুঝাতে বলেছি। তবে আমরা কলেজ ও আশপাশের পরিবেশ ঠিক রাখতে নিয়মিত টহল জোরদার করেছি। 

কলেজকেন্দ্রিক মারামারিতে ছুরি, কিরিচের মতো অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি। যারাই অস্ত্রের ব্যবহার করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। শুধুমাত্র দায়সারা কথা বলেই বাঁচতে চান নগর ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল নেতারা। 

এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সহ- সভাপতি রাকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কখনোই অন্যায়কে সহ্য করে না। আমাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য আগে আসেনি। আমরা কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সেক্রেটারিকে বিষয়টি জানাবো। শিগগিরই এ ব্যাপারে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

এ বিষয়ে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর বলেন, আমরা এসব বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি করব, দেখব কারা এসব বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত। সামনে আমরা কলেজের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করব। তাতে বিশৃঙ্খলাকারীদের বাদ দেয়া হবে।