গ্রাহক পর্যায়ে নির্ধারিত মূল্য বাস্তবায়নে বিইআরসি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি -এম শামসুল আলম; সহসভাপতি, ক্যাব
বিইআরসির কারণে এলপি গ্যাসের দাম সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যাচ্ছে না -আজম জে চৌধুরী; সভাপতি, লোয়ার
ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বেড়েই চলেছে। আগে বাড়া-কমার মধ্যে থাকলেও এখন কমার চেয়ে বৃদ্ধি বেশি।
গতকাল এক হাজার ২৩২ টাকা থেকে এক লাফে ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৪৯৮ টাকা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এই দাম ঘোষণা করেছে। বর্ধিত এই দাম গতকাল থেকেই কার্যকর হয়েছে।
তবে দাম বাড়ার আগেই বাজারে নির্ধারিত দামের অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছিল ভোক্তাদের। এখন সেটি আরও বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলপিজির দাম নির্ধারণে একক এখতিয়ার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। আর এই মূলাহার বাস্তবায়ন করাও বিইআরসির একক এখতিয়ার। আর বিইআরসি সে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
তারা বলছেন, এলপিজির বাজার তদারকির মাধ্যমে সমন্বয় সাধন করা দরকার। তাহলে বর্ধিত দামের পরও সিন্ডিকেটের বাড়তি বোঝা থেকে মুক্তি পাবে সাধারণ গ্রাহক।
সরেজমিন দেখা যায়, দাম বাড়ার আগে গত বুধবার ১২ কেজি সিলিন্ডারের নির্ধারিত মূল্য এক হাজার ২৩২ টাকা থাকলেও খুচরা পর্যায়ে বিতরণ কোম্পানি ভেদে দাম হাঁকা হচ্ছিল এক হাজার ৮০০ থেকে এক হাজার ৯০০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদার আলোকে সরবরাহ কম। তাই বাড়তি দামেও পাওয়া যাচ্ছে না বোতল। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলপি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কথা।
তারা বলছেন, সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে সিলিন্ডারপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। কয়েক দিন আগে এক হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন কেনাই এক হাজার ৮০০ টাকার বেশি। তাই খুচরা এক হাজার ৮৫০ থেকে এক হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ নির্ধারিত দামের চেয়ে দেড়গুণ বেশি দাম গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন গ্রাহক। বাজার মনিটরিং না থাকায় গ্যাসের দাম এভাবে দফায় দফায় বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাসাবাড়িতে গ্যাস না থাকায় এলপিজির কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে সিন্ডিকেট— এমনটাই মনে করছেন অনেক খুচরা ব্যবসায়ী। তারা বলেন, আমরা গ্যাস পাচ্ছি না। কোম্পানিগুলো সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে দাম বেড়ে গেছে হুহু করে। রাজধানীর বেশক'টি এলপিজি বিক্রির দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ দোকানেই খালি কনটেইনার।
দোকানিরা বলছেন, কোম্পানি বন্ধ রেখেছে সরবরাহ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ না নিলে বন্ধ হয়ে যাবে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সমস্যায় পড়তে হবে রাজধানীবাসীকে।
রাজধানীর গেন্ডারিয়ার রাহেলা বেগম থাকেন একটি টিনশেড ঘরে। সেখানে পাইপলাইনের গ্যাস নেই। ফলে তাকে সব সময়ই সিলিন্ডারের ওপর নির্ভর করতে হয়। তিনি জানেন না কখন সিলিন্ডারের দাম বাড়ে কমে। যখন যে দামে বিক্রি হয় তখন সে দামেই কিনতে হয় তাকে।
অথচ টানা কয়েক মাস এলপিজির দাম বাড়লেও জানুয়ারিতে কমেছে ৬৫ টাকা। কিন্তু তা জানেন না গ্রাহকরা। পাননি তার সুফল। গত এক দশক ধরে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে সরকার। যেসব লাইন আছে সেগুলোতেও নিয়মিত গ্যাসের চাপ থাকে না। এতে চাহিদা বেড়েছে বোতলজাত এলপি গ্যাসের।
এই এক দশকে গ্যাস ব্যবহারকারীর সংখ্যা যত বেড়েছে সবই এলপিজিভিত্তিক। বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকানও এখন এই গ্যাসে নির্ভরশীল। ফলে চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিনই সিলিন্ডার জোগান দিতে হয় ডিলারদের। তবে এই সময়ে সারা দেশে সিলিন্ডার ব্যবহারকারী ঠিক কত তা আজও নির্ণয় করতে পারেনি কোনো সংস্থা।
অবশ্য অনেকে মনে করেন, এর সংখ্যা ৫০ লক্ষাধিক। ব্যবসায়ীদের হিসাবে পাঁচ সদস্যের এক পরিবারে গড়ে ১৮ কেজি গ্যাস প্রয়োজন হয়। প্রতি মাসে গড়ে ১২ কেজির ৬৫ লাখ ১২ হাজার বোতল গ্যাস বিক্রি হয়। সে হিসাবে বছরে দেশে এলপিজির চাহিদা ১৪ লাখ টন।
অন্যদিকে সরকারি হিসাবে বেসরকারি এলপিজি রিটেইলার পয়েন্টে ভোক্তাপর্যায়ে মূসকসহ মূল্য প্রতি কেজি ধরা হয়েছে ১০২ টাকা ৭০ পয়সা করে। সে অনুযায়ী ৩৫ কেজির সিলিন্ডারের দাম তিন হাজার ৫৯৫ টাকা। তবে বাস্তবতা হলো- বাজারে এর মূল্য বর্তমানে পাঁচ হাজার ৪০০ টাকা। গ্যাস কোম্পানিগুলোর স্থানীয় ডিস্ট্রিবিউটররা সিন্ডিকেট করে গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ভোক্তা পর্যায়ে সারা দেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম অভিন্ন। কিন্তু এলপি গ্যাসের দামে বিস্তর ফারাক। জ্বালানির দামের এই ভিন্নতা ভোক্তা সাধারণের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে, যা দেশের সংবিধান অনুমোদন করে না।
এ বিষয়ে বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মকবুল-ই এলাহী চৌধুরী বলেন, কাজটি চ্যালেঞ্জিং ও কঠিনও বটে। তবে অসম্ভব নয়। তাদের কাজটির দুটি ভাগ থাকবে।
প্রথমত, এলপি গ্যাসের আমদানি করা কাঁচামালের বাজার দর যেহেতু প্রতি মাসে নির্ধারিত হয়, সেহেতু দেশে তার দাম নির্ধারণের জন্য একটি ফর্মুলা তৈরি করা হবে।
দ্বিতীয়ত, দেশের ভেতরে বিপণনের জন্য একটি অভিন্ন দাম নির্ধারণ করা হবে।
এলপি গ্যাস অপারেটরগুলোর সংগঠন এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়ার) মনে করছে, শিল্প- কারখানাসহ বহুমুখী কাজে এলপি গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহে টান পড়েছে। খুচরায় সরবরাহে ঘাটতির ক্ষেত্রে এটিকেই কারণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। ঘাটতির সুযোগ নিয়ে বাড়ছে দাম। এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর ইস্কাটনে হোটেল ব্যবসায়ী কালাম জানান, গ্যাসের দাম তো আগে কখনো এভাবে বাড়তে দেখিনি। মনে হয় গ্যাসের কিছুটা সংকট আছে। এই সুযোগে দাম বাড়তে শুরু করেছে। এভাবে বাড়লে তো ব্যবসায় টিকে থাকা যাবে না।
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলা বাজারের ব্যবসায়ী নেয়ামত উল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যের সাথে বাজার দরে কোনো সমন্বয় নেই। বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে আমাদের কিনতে হয়। এ ছাড়া বড় সমস্যা হলো- সরবরাহ কোম্পানি ভেদে এলপিজির দামেও অনেক ফারাক। এতে ব্যবসায়ী-ক্রেতা উভয়ই সংশয়ের মধ্যে থাকেন।
এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, 'বিইআরসি অদক্ষ হওয়ার কারণে এলপি গ্যাসের দাম সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। তারা কেবল সৌদি সিপি বিবেচনায় নিয়ে দাম ঠিক করে। অথচ এখানে অনেক প্রিমিয়ামের বিষয় রয়েছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, এলপিজির দাম নির্ধারণের একক ইখতিয়ার রয়েছে বিইআরসির। আর এই নির্ধারিত মূলাহার বাস্তবায়ন করাও বিইআরসির কাজ। বিইআরসি সে দায়িত্ব কখনো পালন করেনি। গ্রাহকরা নির্ধারিত মূল্যে গ্যাস পাচ্ছে কি-না তা সঠিক বাস্তবায়নে বিইআরসি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।