‘বিএনপি দেশের মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে’

মাসুদুল হাসান অলড্রিন প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৩, ০১:১১ এএম

বিগত দুটি সংসদ নির্বাচন, রাজনীতি থেকে নির্বাসিত তারেক রহমান ইস্যু, বিএনপির নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সংকট ও সাম্প্রতিক আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, লক্ষ্য পূরণে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের গতিশীলতা ও সরকারের নানা অর্জন এবং রাজনীতির সমসাময়িক নানা ইস্যুতে আওয়ামী লীগের পঞ্চমবার নির্বাচিত সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হকের সাথে কথা বলেছেন আমার সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদক মাসুদুল হাসান অলড্রিন

বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল কেন অংশগ্রহণ করল না, এ প্রেক্ষিতে বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, বিএনপি ইতোমধ্যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা বারবার ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কারণে এটা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা তখনকার বিএনপির দলীয় প্রধানকে টেলিফোন করেন, আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ তাদের পছন্দমত মন্ত্রণালয়ের নাম প্রস্তাব করতে বলেন। 

শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি নির্বাচনকালীন সরকার থাকবে যারা নির্বাচন পরিচালনা করবে। তখন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কোনো রকম সদুত্তর দেননি, এমনকি সুন্দর ব্যবহারও করেননি। যা চূড়ান্ত অশোভন ছিল। 

তিনি বলেন, বিএনপি ইচ্ছা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার মধ্য দিয়ে তারা আওয়ামী লীগকে বিপদগ্রস্ত করার কূটকৌশল অবলম্বন করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে সে কৌশল বাস্তবায়ন করতে পারেনি। শেখ হাসিনা সততা, ধীরস্থিরতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে এটি অতিক্রম করেছেন।

বিএনপি কেন নির্বাচনে এলো না, আপনারা এ বিষয়ে কতটা উদার ছিলেন জানতে চাইলে এই সিনিয়র নেতা বলেন, এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আসার কথা বললেন। বিএনপি ও ডা. কামাল হোসেনসহ ২০ দলীয় জোট তাদের শরিকসহ আলোচনায় এলেন, কথা বললেন। বললেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একই আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে দুই-তিনজনকে নমিনেশন দেয়া হলো। তাদের প্রার্থী ঠিক করতে করতে সময় চলে গেল এবং দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান, যিনি শেখ হাসিনাকে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে হত্যার প্রচেষ্টায় মূল কুশীলব, লন্ডনে বসে বিএনপিকে টাকা রোজগারের মেশিন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। 

একই আসনে একাধিক প্রার্থীর কাছ টাকা সংগ্রহ করে তারা নির্বাচনটি ঠিকভাবে করেনি, জনগণ জানে এসব। তাদের সেই অপকর্মের দায় আওয়ামী লীগের বিরদ্ধে চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মূলত তাদের তেমন কোনো প্রার্থীই ছিল না এবং তাদের প্রার্থীকে ঠিকমত নির্বাচন করতেই দেয়নি। তোতা পাখির বুলির মতো তারা বলতে থাকে যে রাতের আঁধারের ভোট; এগুলো অবান্তর ব্যাপার। মূলত তাদের প্রার্থীরা জনগণের ধারে কাছেই যায়নি, ভোট সংগ্রহ করার কোনো চেষ্টা করেনি। 

বিএম মোজাম্মেল প্রশ্ন রাখেন, বারবার ভুল সিদ্ধান্তের দায় কার? ২০১৪ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য তাদের কূটকৌশল ছিল অগ্নিসংযোগ, বোমাহামলা ও সাধারণ মানুষ হত্যা- এসব করার মধ্য দিয়ে বিএনপি মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। তাদের আন্দোলন ছিল খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই। দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার মুক্তি চায়। বোমাহামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে। কিন্তু তারা কখনো গণমানুষের কথা বলেনি। ইদানীং তারা কিছু পরিবর্তন আনতে ২৭ দফায় যা যা দিয়েছে এর মধ্যে উসকানি আছে। ষড়যন্ত্র আছে। যদিও বিএনপির সৃষ্টি হয়েছে ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যা করার পর খুনি মোস্তাক ও জিয়া গণতন্ত্রকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে দিয়েছে। বন্দি গণতন্ত্রকে মুক্ত করার জন্য এদেশের মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে লড়াই সংগ্রাম করেছে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। 

বিএনপি বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছে এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রথম তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল। যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে যাদের বিচারের ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধু করে গিয়েছিল তাদের, কারাগারে বন্দি ছিল। তাদের খুনি জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত করে দেন। যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের বিচার বন্ধ করে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, কোনো ধর্মভিত্তিক বাংলাদেশ নয়। আবার সেই ধর্মকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছে জিয়াউর রহমান। একাত্তর ও পঁচাত্তরের কুশীলব মুস্তাক ও জিয়া, জাতীয় চার নেতাকে জেলে হত্যা করল। ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না, এমন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করল।

আওয়ামী লীগের এই সিনিয়র নেতা আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না; এটা মানবাধিকার হরণ করা নয়? এবং সেটাতে মোস্তাক ইনডেমিনিটি জারি করল এবং জিয়া পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্টের মাধ্যমে আইনে পরিণত করেছিল। আজও তারা সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে দলীয় কাঠামো কার কতটা শক্ত এ বিষয়ে তিনি বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তির উত্তরাধিকারদের নিয়ে বিএনপি একটি হ-য-ব-র-ল রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। এখানে কোনো নীতি নেই, আদর্শ নেই। ওরা সবসময় বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলে অথচ তারা ক্যান্টনমেন্টে গণতন্ত্র বন্দি করে ফেলেছিল। কার্ফু গণতন্ত্র চালু করেছিল জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে কারফিউ ছিল। যেখানে কারফিউ থাকে সেখানে গণতন্ত্র থাকে না। বিএনপি গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিল। মানবাধিকার হত্যা করেছিল। সুতরাং এসব কারণে জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ একটি শতভাগ গণমুখী গণতান্ত্রিক দল এবং আওয়ামী লীগের দলীয় কাঠামোর ভিত্তি অনেক মজবুত। সাম্প্রতিক জাতীয় সম্মেলনে দলের জাতীয় কাঠামো আরও মজবুত হয়েছে। 

তিনি বলেন, ৯১ সালের ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনরত মানুষকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছিল। মানুষ সার চেয়েছিল, তারা সেই সারের জন্য মানুষকে হত্যা করেছিল। ২০০১ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন ওই সময়টা তারা বাংলাদেশকে একটি লুটপাটের দেশে পরিণত করেছিল। সে কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর দুর্নীতির দেশে পরিণত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এরপর ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে ২৬ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করে। এরা বারবার মানবাধিকার হরণ করেছে। লুটপাট করেছে। দেশটাকে জাহান্নামে নিয়ে গিয়েছিল।

বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা বারবার সংবিধান বিকৃত করেছে, সংবিধানকে হত্যা করেছে। ওরা কিসের রাষ্ট্র মেরামত করবে? বরং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারই সেটা মেরামত করেছে। 

দুবারের এই সংসদ সদস্য বলেন, আজকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে এসেছে। ভোটের অধিকার ফিরে এসেছে। গণমানুষের অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নয়নের রোলমডেল। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এখন বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। সারা বাংলাদেশের মানুষ আশান্বিত হচ্ছে। উত্তর বঙ্গের মঙ্গা জাদুঘরে চলে গেছে। সারা বাংলাদেশে উন্নয়ন ঘটছে। 

সরকারের অর্জন নিয়ে তিনি বলেন, সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে, মানুষের খাদ্যাভাব নেই। শেখ হাসিনার সরকার কয়েক লাখ গৃহহীন- ভূমিহীন মানুষকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ঘর করে দিয়েছে। সরকার বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত চার কোটির বেশি বই বিতরণ করেছেন। দুই কোটি ৫৬ লাখ ছেলেমেয়েকে বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়েছেন। দেশের প্রতিটি উপজেলা সদর হাসপাতালকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করেছেন।

বিএম মোজাম্মেল বলেন, আমার উপজেলায় ৬৪ শয্যার হাসপাতাল করা হয়েছে। জেলা সদরের হাসপাতালগুলোকে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করেছেন। ছয়টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৫৫টি। আর বেসরকারি শতাধিক মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিয়েছেন। সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন অগ্রগতি। ওরা বাংলাদেশকে ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্র বানাতে চায় এবং ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় জঙ্গিবাদী শক্তিকে ডেকে এনে এটাকে আফগানিস্তান বানাতে চায়।

আওয়ামী লীগের পঞ্চমবারের এই সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, বিএনপি বাংলাদেশকে আদিম যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। বিএনপি নেতারা বলেন, পাকিস্তান আমলে ভালো ছিলেন, অথচ তখন ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। আমি নিজে দেখেছি। আমি গ্রামের ছেলে। তখন আমার গ্রামের মানুষ তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারত না। অথচ আজকে দেশের কোথাও মানুষ না খেয়ে থাকে না। এখন দরিদ্র আছে ২০ ভাগ এবং অতিদরিদ্র নেমে এসেছে তিন-চার ভাগে। এদেশের স্বাধীনতা ও আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকার ফিরে পেয়েছিলাম। এটা শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বেড়াজাল ডিঙিয়ে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪১ সালের মধ্যে একটি আধুনিক, উন্নত, সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব। সব বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে আমরা এগিয়ে যাব এবং একটি অসাম্প্রায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করব।