চারদিকে মৃত্যুমিছিল-হাহাকার। রাস্তায় সারি সারি মৃতদেহ। ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আছে অর্ধদেহ। তুরস্ক-সিরিয়া এখন শুধু কংক্রিটের স্তূপ। শহর, মফস্বল, পাড়া, অলিগলির মানচিত্র ধ্বংসলীলায় একেবারে বদলে গিয়েছে। আগে যেখানে শপিংমল ছিল, এখন সেখানে ইট, কাঠ-পাথরের স্তূপ। এর মধ্যে কেউ কাঁদছেন ক্ষুধায়, কেউ চোখের সামনে হারাচ্ছেন আপনজন! প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, তুষারপাত, আশ্রয়ের অভাব, খাবার না পেয়ে দিশাহারা মানুষ। কম্পনের পর থেকে আতঙ্কে গাজিয়ানটেপ ছেড়ে দলে দলে চলে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। এমন দৃশ্য এখন বিশ্ব গণমাধ্যমে। কাঁদছে সারা দুনিয়া। হাজারো শোক গল্প। ১২ হাজার বাড়ি কম্পনে মাটিতে মিশে গিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও অনুমান করছে, তুরস্ক এবং সিরিয়াজুড়ে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বহু এলাকায় রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় উদ্ধারকারীরা
পৌঁছতে পারছেন না। পৌঁছচ্ছে না ত্রাণও। ফলে এলাকায় এলাকায় ক্ষোভ বাড়ছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভূমিকম্পে বেঁচে গিয়েও প্রাণ সংশয় তৈরি হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই ঠাণ্ডায় খোলা আকাশের নিচে যারা দিন কাটাচ্ছেন, তাদের হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমে যাবে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আবারও ভূমিকম্প হতে পারে এই আশঙ্কায় কোটি মানুষকে ঘরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। প্রায় ২০ হাজার মানুষ হাসপাতালে আহত অবস্থায় পড়ে আছে। মৃতের সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আহত ৫০ হাজারেরও বেশি। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চলছে উদ্ধারকাজ। এর মধ্যে আবার তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রবল ঠাণ্ডা পড়েছে। চলছে তুষারপাত। তাপমাত্রা শূন্য থেকে ৩ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। তুরস্ক প্রশাসন জানিয়েছে, ভূমিকম্পের জেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর তো বটেই, রাস্তাঘাট এমনকি বিমানবন্দরের রানওয়ে দুভাগ হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত এলাকায় উদ্ধারকারী দলের পৌঁছতে সমস্যা হচ্ছে। ত্রাণসামগ্রীও পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন। আগামী তিন মাস তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বের ১০টি প্রদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা এখন ১৫ হাজার ৩৮৩। এদিকে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল গাজিয়ানটোপ ও কাহমানমারাসের বাসিন্দারা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করেছে। অভিযোগ, ত্রাণসামগ্রী পাচ্ছেন না তারা। উদ্ধারকারী দলও নাকি সেই এলাকায় নেই। দ্রুত উদ্ধারকাজ চালানো যে সম্ভব হচ্ছে না তা স্বীকার করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্টও। আমেরিকা, বাংলাদেশ, চীনসহ অন্তত ৭০ দেশ তুরস্কের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তুরস্কে অবস্থানরত বাংলাদেশি লেখক হাফিজুর রহমান বলেন, অবস্থা ভয়াবহ, তুরস্কের পাশে দাড়ান! ভূমিকম্পে যে ১০টা প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার আয়তন মোটামুটি গোটা বাংলাদেশের সমান হবে। তাতে এখন পর্যন্ত নিহতের যে সংখ্যা আসছে তা সামান্যই, বিশাল অংশ এখনো উদ্ধার তৎপরতার বাইরে। গতকাল রাতে গাজিয়ানতেপ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বলতেছিলেন, তার এলাকার একটি উপজেলার অর্ধেক মাটির নিচে ধসে গেছে। ষাট হাজার জনসংখ্যার এই উপজেলায় অর্ধেক মানে ৩০ হাজার। এরকম কয়েকটি উপজেলা প্রায় পুরোপুরি আর বাকিগুলো আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। সরকারিভাবে প্রায় দেড়কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্তের কথা বলা হচ্ছে। এদের সবাই এখনো বাইরে, এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। আবারও ভূমিকম্প হতে পারে এই আশঙ্কায় তাদেরকে ঘরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। আর কয়েক হাজার বিল্ডিং ধসে পড়েছে। তাতে কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। এদিকে প্রচণ্ড তুষারপাতে নাভিশ্বাস অবস্থা। প্রায় ২০ হাজার মানুষ হাসপাতালে আহত অবস্থায় পড়ে আছে। এ অবস্থায় যার যার অবস্থান থেকে তুরস্কের পাশে দাঁড়ানো জরুরি। যে তুরস্ক গত কয়েক দশক সারা বিশ্বের বাস্তুচ্যুত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, মজলুমদের পাশে দাঁড়িয়েছে এখন সময় তাদের পাশে দাঁড়ানোর। বাংলাদেশ সরকার এবং নানা সহযোগিতা সংস্থার প্রতি অনুরোধ প্লিজ তুরস্কের পাশে দাঁড়ান। যতটুকু সম্ভব জরুরি সহায়তা সামগ্রী পাঠান। ব্যক্তিগতভাবেও যাদের সুযোগ আছে তারা চেষ্টা করুন। অন্তত নামাজ পড়ে দোয়া করুন। রাব্বুল আলামিন সহায় হোন। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে তুরস্ককে উদ্ধার করুন। আমিন।
ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়াদের বাঁচিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ সামনে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, মানবিক সংস্থাগুলোর সামনে এখন তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের বাঁচিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ আসছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির ইনসিডেন্ট রেসপন্স ম্যানেজার রবার্ট হলডেন এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এখন হাজার হাজার মানুষ খোলা জায়গায়, খারাপ ও ভয়াবহ অবস্থায় বেঁচে আছে। যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিতসহ পানি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নেই। হলডেন বলেন, আমরা সেকেন্ডারি বিপর্যয় মুখে পড়ার প্রকৃত ঝুঁকিতে আছি। আমরা অনুসন্ধান ও উদ্ধার তৎপরতা যে গতিতে চালিয়েছি সেই একই গতিতে এগিয়ে না এলে, ভূমিকম্পে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে অধিক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। তিনি বলেন, এটা সহজ কোনো কাজ নয়, এই কাজের মাত্রা ব্যাপক। উল্লেখ্য, গত সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপের (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পটি গাজিয়ানটেপ প্রদেশের নুরদাগি এলাকা থেকে ২৩ কিলোমিটার পূর্বে আঘাত হানে। এর গভীরতা ছিল ২৪ দশমিক ১ কিলোমিটার। এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত দেশ দুটিতে ১৭ হাজার ৫১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কে ১৪ হাজার ৩৫১ জন এবং সিরিয়ায় তিন হাজার ১৬২ জনের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত : ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করেছে বাংলাদেশ। গত বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে এই শোক ঘোষণা করা হয়। শোক পালনের অংশ হিসেবে গতকাল দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি নিহতদের আত্মার শান্তির জন্য দেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। প্রসঙ্গত, গত সোমবার ভোরে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানতেপে ৭ দশমিক ৮ মাত্রায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মাত্র ১০০ কিলোমিটার উত্তরে ৭ দশমিক ৫ মাত্রায় আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। বড় ধরনের এই ভূমিকম্পে আশপাশের অঞ্চলগুলো পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এতে হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়।
২১ বাংলাদেশি আঙ্কারায় দুজন হাসপাতালে : তুরস্কে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে ২১ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে দেশটির রাজধানী আঙ্কারায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুজনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন গতকাল বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। সেহেলী সাবরীন বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে এই ২১ জনকে আঙ্কারায় সরিয়ে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে দুজনকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তুরস্কে বর্তমানে ৫-৭ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছেন বলে জানিয়েছে আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস। তবে শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশির মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গত সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে। এরপর আরও কয়েক দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ১৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। এর মধ্যে তুরস্কে ১৪ হাজার ৩৫১ জন এবং সিরিয়ায় তিন হাজার ১৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে সতর্ক করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।