অবিলম্বে চুক্তি বাতিল করে এর সাথে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে
—অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
বেসরকারি সংস্থার সাথে সরকারের চুক্তি অনৈতিক পরবর্তী সরকার চুক্তি পুনর্বিবেচনা করবে
—বরকত উল্লাহ বুলু
ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে করা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চুক্তিকে অস্বচ্ছ ও বৈষম্যমূলক দাবি করা হচ্ছে। চুক্তিটি বর্তমানে দুই দেশেই আলোচনার তুঙ্গে উঠেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চুক্তিটির জন্য দেশকে বহু বছর খেসারত দিতে হবে। তাই অবিলম্বে এটি বাতিল করে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বিরোধী দলগুলোও তীব্র সমালোচনা করে চুক্তি বাতিলের পক্ষে মত দিচ্ছে। খোদ ভারতের বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও চুক্তির বিষয়ে দেশটির সরকারের স্পষ্ট বক্তব্য চাওয়া হয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, আদানি গ্রুপের সাথে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চুক্তির পেছনে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের ভূমিকা স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়েছেন রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য জওহর সরকার। এ জন্য গত বছরের ডিসেম্বর থেকে জওহর সরকার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে ক্রমাগত চিঠি দেয়া হচ্ছে। ওইসব চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়েছে— বাংলাদেশ যাতে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে, সে জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নিজে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন কি-না। সর্বশেষ গত ১৩ ফেব্রুয়ারির চিঠিতে তিনি লিখেছেন, আদানির সাথে ওই চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অন্যায্য দামে আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশের কাছে বিক্রির ওই চুক্তি বাংলাদেশে ভারতবিরোধী অসন্তোষ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ চুক্তির বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেশে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিন-চারগুণ বেশি দামে বৈদেশিক মুদ্রায় করা এ চুক্তির কোনো প্রয়োজন ছিল না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করতে ও আদানিকে লাভবান করতেই এমন চুক্তি করা হয়েছে। বহু বছর ধরে দেশকে এর খেসারত দিতে হবে। অবিলম্বে এই চুক্তি বাতিল করতে হবে এবং যারা এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী চুক্তির সাথে জড়িত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’ এই মুহূর্তে চুক্তি থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে আইনগত বাধা আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাধা থাকলে তা সরকারকেই দূর করতে হবে। কারণ জনগণের ট্যাক্সের টাকার দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।’ অন্যদিকে চুক্তিটি অস্বচ্ছ ও বৈষম্যমূলক দাবি করে পুনর্বিবেচনা ও প্রয়োজনে বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। গত শুক্রবার টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আদানি গ্রুপের সাথে সম্পাদিত পিডিবির এই চুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে নির্ভরযোগ্য বিশ্লেষণে অসম ও অস্বচ্ছ এবং বাংলাদেশের জন্য অভূতপূর্বভাবে বৈষম্যমূলক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চুক্তিটিতে বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে আদানি গোষ্ঠীকে এমনভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত এই প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে যেতে পারে, যার বোঝা এ
দেশের জনগণকে বইতে হবে।’ দেশের বিরোধী দলগুলোও এ চুক্তিকে দেশের স্বার্থবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু আমার সংবাদকে বলেন, ‘কোনো বেসরকারি সংস্থার সাথে কোনো দেশের সরকার চুক্তি করতে পারে না। এ ধরনের চুক্তি রহস্যজনক। সাধারণত চুক্তি হয় সরকারের সাথে সরকারের। সরকারি পর্যায়ে চুক্তি হলে দাম কম পড়ে ও টাকা পাচারের ঝুঁকি থাকে না। বেসরকারি কোম্পানির সাথে চুক্তির কারণে ওভার ইনভয়েসিং ও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের শঙ্কা রয়েছে। পরবর্তী সরকার জনস্বর্থবিরোধী ও বৈষম্যমূলক এ চুক্তি পুনর্বিবেচনা করবে।’ তবে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের পক্ষ থেকে কয়লার দাম নিয়ে আপত্তি তোলা হলেও এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আমার সংবাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তবে গত ৫ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে তিনি দাবি করেছিলেন, নির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী মার্চের প্রথম সপ্তাহে ৭৫০ মেগাওয়াট ও এপ্রিলে আরও ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসা শুরু হবে। এর আগে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড আদানি পাওয়ারকে চিঠি লিখে জানিয়েছে, তারা প্রতি টন ৪০০ ডলার হারে জ্বালানি কয়লার যে দাম ধার্য করেছে, বাংলাদেশ মনে করে— সেটি আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি। কয়লার দাম পুনর্বিবেচনার এই দাবি ওঠার পর থেকে আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। একই সাথে বাংলাদেশ ও ভারতে চুক্তিটি বাতিলের দাবি ওঠে।
প্রসঙ্গত, ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানি গোষ্ঠীর গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি হয়। তবে কবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে, তা নিয়ে সম্প্রতি অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে এক দফা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। তবে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ীই চলছে বলে বাংলাদেশ সরকার ও আদানি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। এর আগে আদানি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান গৌতম আদানি নিজেই গত বছরের ১৬ ডিসেম্বরের ডেডলাইন ঘোষণা করেছিলেন, যেটি ইতোমধ্যেই অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন নতুন ডেডলাইন ধরা হয়েছে মার্চের মাঝামাঝি সময়। ২০১৭ সালে আদানি পাওয়ারের সাথে বাংলাদেশের পিডিবি যে ২৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি করেছিল, তাতে বলা হয়েছিল— জ্বালানির আমদানি ও পরিবহন খরচ ক্রেতা দেশই (বাংলাদেশ) বহন করবে। ফলে গোড্ডার বিদ্যুতের দামে জ্বালানির খরচ একটি বড় ফ্যাক্টর। কিন্তু আদানি গোষ্ঠী তাদের ডিমান্ড নোটে প্রতি টন কয়লার যে মূল্য (৪০০ মার্কিন ডলার) ধার্য করেছে, বাংলাদেশ মনে করছে, সেটি আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে অনেকটাই বেশি।
সমপ্রতি ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা গৌতম আদানির সম্পর্কে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কিন বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ফার্ম। গত ২৪ জানুয়ারি প্রকাশ করা সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, এক দশককালেরও বেশি সময় ধরে শেয়ার কারসাজি ও আর্থিক লেনদেনে প্রতারণা চালিয়ে আসছে আদানি গ্রুপ। কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বহুগুণ বাড়িয়ে এ গ্রুপ বিশাল সম্পদ গড়েছে। গত কয়েক বছরে আদানি গ্রুপের কোম্পানির শেয়ার ৫০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের তোলা অভিযোগের ভিত্তিতে গৌতম আদানির মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে ভারতের অর্থনৈতিক বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। শেয়ারবাজার কারসাজি ও আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পর থেকে এরই মধ্যে প্রায় ১২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার লোকসান হয়েছে ভারতীয় এ ধনকুবেরের। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে আদানি গ্রুপ।