বইমেলায় হতাশায় পাঠক

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৩, ০২:০১ এএম
  • পাঠকপ্রিয় কয়েকটি প্রকাশনীকে মেলায় স্থান দেয়া হয়নি
  • আদর্শ প্রকাশনী ও বই নিষিদ্ধের ব্যাপারে পাঠকদের রয়েছে তুমুল সমালোচনা

 

ভালো-মন্দ যাচাইয়ের ব্যাপারটি পাঠকের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত

—আফসানা আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, জবি

 

জাফর মাহমুদ, মিরপুর থেকে বইমেলায় এসেছেন। কিনতে চান, প্রিয় লেখক সাব্বির জাদিদের ‘প্রজ্ঞায় যার উজলা জগৎ’ বইটি। কয়েকটি স্টলে খোঁজ নেয়ার পরও বই তিনি পাননি। পরে জানতে পারেন বইটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘গার্ডিয়ান প্রকাশনীকে’ মেলায় স্থান দেয়া হয়নি। জাফর মাহমুদের ভাষ্য, ‘এটা তো বইমেলা। এখানে আমরা আসি পছন্দের বই কিনতে। মেলা তো আর কোনো ধর্মীয় স্থান না! আধুনিক সময়েও বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা মেনে নেয়া যায় না। বিশেষ করে বাংলা একাডেমি তো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এমন একটি সংগঠন এরকম অযাচিত সিদ্ধান্ত কীভাবে নেয়? পাঠকের যদি বই পছন্দ না হয় তাহলে প্রকাশনী তো এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।’ একই রকম ক্ষোভ আরও কয়েকজন পাঠক প্রকাশ করেন। এ বছর মেলার প্রথম থেকেই আদর্শ প্রকাশনী নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা গিয়েছে। মানহীন বইয়ের অজুহাত দেখিয়ে আরও কয়েকটি প্রকাশনীকে স্টল দেয়া হয়নি। এ ছাড়াও প্রথম থেকে অনুমতি মিললেও বইয়ের লেখায় বিতর্ক দেখা দেয়ায় একটি বইকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমি বলছে, বইমেলার নীতিমালা অনুসরণ না করায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল দেয়া হয়নি। গার্ডিয়ান প্রকাশনী মানহীন বই প্রকাশ করে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, সমাজে জ্ঞানের সমান চর্চা থাকা প্রয়োজন। ভালো-মন্দ যাচাইয়ের ব্যাপারটি পাঠকের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত।

পছন্দের প্রকাশনীর বই না পাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লুতফুর রহমান বলেন, এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে রাজনীতি নেই। খুবই লজ্জাজনক! কোনো প্রকাশনী কি বই প্রকাশ করেছে সেটা পাঠক কিভাবে নিয়েছে সেটা পাঠকের বিষয়। এ ব্যাপারে নেটিজেন পাড়ায়ও রয়েছে তুমুল সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জাওয়াদ আহমেদ নামে একজন বলেন, এক সময় বাংলা একাডেমিকে সবাই সম্মানের চোখে দেখত। এখন আর সেই মান আছে বলে মনে হয় না। নিজেদের চিন্তার বাইরে তারা অন্য কোনো বই মেনে নিতে পারছে না। এটাতো জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।

 

‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ নামে একটি বইকে ১৪ ফেব্রুয়ারি মেলা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে লেখক জান্নাতুল নাঈম প্রীতি গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নাই। অদূর ভবিষ্যতে ‘বাক স্বাধীনতা’ থাকবে কিনা, এটা বাংলাদেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে। আমি কেবলমাত্র এটুকুই বলব।

একটি নির্দিষ্ট বইয়ের কারণে আদর্শ প্রকাশনীকে প্রথম থেকে স্টল দেয়া হয়নি। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট ‘বিতর্কিত’ তিনটি বই বাদ দিয়ে আদর্শকে স্টল দেয়ার আদেশ দেয়। কিন্তু গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়ার যে আদেশ হাইকোর্ট দিয়েছিল, তা স্থগিত করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। এ ব্যাপারে আদর্শ প্রকাশনীর মালিক মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। পাঠকই এর বিচার করবে। স্টল না দেয়ায় আমরা পাঠকদের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। বইটির ব্যাপারে তিনি বলেন, “কমিটির সদস্যসচিব আমাকে বলেছেন, ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটির জন্য আপনি দুঃখপ্রকাশ করে আমাদের চিঠি লিখবেন। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় বলে যে, এ বইটা আপনি স্টলে রাখতে পারবেন না। আমি তাদের কথায় অসম্মতি জানিয়েছি।”

বইমেলায় আদর্শকে স্টল না দেয়ার ব্যাপারে জনসংযোগ উপবিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আকবর হোসেনের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলা একাডেমি জানায়, বইটির ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় বাঙালি জাতিসত্তা, ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বিচার বিভাগ, বিচারপতি, বাংলাদেশের সংবিধান, সংসদ সদস্য; ২০ নম্বর পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ৭১ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অশ্লীল, রুচিগর্হিত, কটাক্ষমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে। যা সংবিধানের ৩৯ (২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থী। অনুরূপভাবে কমিটি মনে করে, বইটি বইমেলার নীতিমালা ও নিয়মাবলির পরিপন্থী। বইটি রাখার বিষয়ে ‘আদর্শ’র প্রকাশক মাহাবুব রহমানের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি উপর্যুক্ত বইটি স্টলে প্রদর্শন ও বিক্রয়ের জন্য রাখবেন বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, যা বইমেলার নীতিমালায় বর্ণিত শর্তাবলির সম্পূর্ণ  বিপরীত। 

এ ছাড়া মেলায় পাঠক প্রিয় প্রকাশনী গার্ডিয়ান ও সমকালীনকে স্টল দেয়া হয়নি। গত বছর অন্য স্টলের সঙ্গে সমন্বয় করে বই বিক্রি করতে পারলেও এবার প্রকাশনী দুটো সে সুযোগও পায়নি। সমকালীন প্রকাশনীর মালিক আফসারুল হক (আনাস) বলেন, এবার আবেদন করেও আমরা বইমেলায় স্টল পাইনি। প্রতি বছরই স্টলের জন্য আবেদন করলেও কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। এ বছর আমাদের বইও মেলায় ঢুকতে দেয়া হয়নি।

জনপ্রিয় বই প্যারাডক্সিকেল সাজিদ বইটির প্রকাশক গার্ডিয়ান প্রকাশনীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুর মোহাম্মদ তাহের বলেন, মেলায় স্টল দেয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। বাংলা একাডেমি জানিয়েছে গার্ডিয়ান প্রকাশনীর বই মানহীন। আমরা এই কথাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই মাসে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এক লাখ বই বিক্রি করব।

আফসানা আহমেদ- সহযোগী অধ্যাপক, জবি সমাজে জ্ঞানের সমান চর্চার কথা জানিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আফসানা আহমেদ বলেন, সমাজে মত ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। জ্ঞানের বিকাশ না হলে সমাজ উন্নত হয় না। বাংলা একাডেমিকে সার্বজনীন হতে হবে। সব মতাদর্শের স্টল সমানভাবে থাকুক। মত ভিন্নতার কারণে কোনো প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়া না হলে ওই প্রকাশনীর জনপ্রিয়তা বাড়ে। মানুষ কৌতূহলী হয়ে ওঠে। সমাজে জ্ঞানের সমান চর্চা থাকা প্রয়োজন। বইয়ের মানের ব্যাপারটি পাঠকের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত।