বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব রাজপথে আন্দোলনে ‘ধীরে চলো নীতি’ অবলম্বন করতে চাইলেও কঠোর কর্মসূচির দাবি করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। দলটির মিত্ররাও বিএনপিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, হরতাল-অবরোধসহ রাজপথে কঠোর অবস্থান ছাড়া দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ও তার মিত্রদের এখন মূল দাবি— আগামী নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে নয়। তারা নির্বাচনকালীন একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর এ দাবি মোটেই আমলে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করে, নির্দলীয় সরকারের ধারণাটি এখন আর চলে না, সংবিধানে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা আছে র্িঠক সেই প্রক্রিয়ায়ই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একই ইস্যুতে দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতমুখী অবস্থানে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা চাইবে তাদের দাবি আদায়ে রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগও চাইবে আন্দোলন ভেস্তে দিতে রাজপথে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। অতীতে রাজপথে দুই পক্ষের কঠোর অবস্থানের কারণে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ক্ষতির মুখে পড়েছে।
ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এবার মসনদে বসতে মরিয়া। এ জন্য দলটি কৌশলে পা ফেলছে। গত নির্বাচনের আগে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফোরাম গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। সেই নির্বাচনে দলটির শোচনীয় পরাজয় হয়। নির্বাচনের মাঠ সমতল ছিল না বলে তখনই বিএনপি ও তার মিত্ররা অভিযোগ করে। অতীতের এই ভরাডুবিকে মাথায় রেখে এবার দলটি কোনোভাবেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার চিন্তা মাথায়ই আনছে না। সরকারও সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার বিষয়ে অনড়। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারে বাধ্য করতে চোখ-কান খোলা রেখে এগোচ্ছে। একাদশ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ ছিল, নির্বাচনেও গেছে ঐক্যবদ্ধভাবে। এবার কিন্তু আক্ষরিক অর্থে কোনো জোটে নেই বিএনপি। তবে বিএনপিকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী একাধিক জোট ও মঞ্চ গঠিত হয়েছে। আর এসব জোট ও মঞ্চ গড়ার নেপথ্য কারিগরের ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি। ফলে এক মঞ্চে সব দলকে জড়ো না করে বিএনপি একই দাবিতে মিত্রদের রাজপথে সোচ্চার থাকার কৌশল নিয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির দাবিগুলো নিয়ে সরকারবিরোধী সব জোট ও মঞ্চ পৃথক পৃথক সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ করছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা কোনোভাবেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবেন না।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, তার দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে মাঠে রয়েছে। দাবি আদায়ের পরই ঘরে ফিরবেন। আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। তিনি বলেন, দলের পক্ষ থেকে ঘোষিত ১০ দফা বাস্তবায়নের পরই তারা নির্বাচনে যাবেন। শেষ পর্যন্ত ১০ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হলে বিএনপি কী করবে— আমার সংবাদের এমন প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, দাবি আদায় না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। দাবি আদায়ের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশের সব জেলায় জেলায় যুগপৎ ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচির পালন করবে বিএনপি ও তার রাজনৈতিক মিত্ররা। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এ বিজ্ঞপ্তিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কর্মসূচি ঘোষণা দেন। ‘বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দমন-পীড়নের প্রতিবাদে ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি সব নেতাকর্মীর মুক্তি এবং সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিলসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ১০ দফা দাবিতে’ বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট পদযাত্রা কর্মসূচি পালনে সক্রিয় থাকবে। এর আগে ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণে দুটি পদযাত্রা কর্মসূচি হয়। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ ১১টি মহানগরে পদযাত্রা কর্মসূচির আরেক পর্বও অনুষ্ঠিত হয়। তারও আগে ১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা করেছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। ওই কর্মসূচি পালনকালে অন্তত ৪০টি জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে হামলার শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ করা হয় ওই দিন বিএনপি তাদের কর্মসূচিতে হামলা করেছে বলে। বিএনপির হামলায় ক্ষয়-ক্ষতির কিছু চিত্রও তুলে ধরা হয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পাঠানো সংবাদ বিবৃতিতে।
এদিকে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি জেলাগুলো বিএনপির পদযাত্রার দিন ঘরে বসে থাকবে না আওয়ামী লীগ। দলটির পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছে, বিএনপির কর্মসূচির দিনে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ। তারা ওই দিন শান্তি সমাবেশ করবে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনকে নির্বাচনি প্রস্তুতির অংশ বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচির বিপরীতে শান্তি সমাবেশের মধ্য দিয়ে নিজেদের নির্বাচনি প্রস্তুতিও গুছিয়ে আনতে চায় ক্ষমতাসীনরা। সারা দেশেই বিএনপি কর্মসূচির দিন সক্রিয় থাকবে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে রাজধানীতে দলটি একটু বেশি তৎপরতা দেখাবে। এ লক্ষ্যে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হবে। ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির আমার সংবাদকে বলেন, ঢাকায় দলীয় তৎপরতা আরও বাড়াবে তার দল। গতকাল বুধবার তিনি বলেন, আগামীকাল (আজ বৃহস্পতিবার) দলের যৌথ সভা আছে। ওই সভায় গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত আসবে। ঢাকায় কী ধরনের কর্মসূচি পালিত হবে সে বিষয়েও যৌথসভায় আলোচনার পর সিদ্ধান্ত আসবে।