নারী জনপ্রতিনিধিদের কাজের সুযোগ সংকুচিত

মাসুদুল হাসান অলড্রিন প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৩, ০২:২৭ পিএম

সিদ্ধান্ত দেয়া ও নথিপত্রে স্বাক্ষরের ক্ষমতা দিতে হবে

—সাদেকা হালিম, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আওয়ামী লীগ, সাবেক তথ্য কমিশনার

 

 পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা

—শামসুন্নাহার চাঁপা, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

 

 পুরুষ এমপিরা আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভাবেন

—সেলিনা জাহান লিটা,সাবেক সংসদ সদস্য

 

নির্ধারিত আসনে কাজের সুযোগ সীমিত

—মেহজাবিন খালেদ, সাবেক সংসদ সদস্য সংরক্ষিত নারী আসন

গত দেড় দশকে রাজনীতিতে নারীর সম্পৃক্ততা বেড়েছে। এর বিপরীতে বিভিন্নভাবে নারীর ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্তও কম হয়নি। যদিও রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধিত্বে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়াতে সরকারের উদ্যোগ আর প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। কিন্তু সচেতন নারীদের একাংশ মনে করেন, কিছু পুুরুষ সহকর্মীর মধ্যে বঞ্চিত করার মানসিকতা রয়েছে। কেউ কেউ বৈষম্যমূলক আচরণ করেন বলেও অভিযোগ তাদের। আর এটাকেই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট নারীরা। এর থেকে উত্তরণে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তনের কথা বলছেন সচেতন নারীদের একটি অংশ। নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীরা ঠিক কতটা ক্ষমতাবান হয়েছেন—  সচেতন মহলে এ প্রশ্ন এখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে দেশের উপজেলা পরিষদের একাধিক নারী ভাইস চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সংরক্ষিত সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য বা নারী কাউন্সিলর, এমনকি সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যরাও এ প্রসঙ্গে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, নানা কারণে পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় তারা কম গুরুত্ব পাচ্ছেন, পর্যাপ্ত বরাদ্দও পাচ্ছেন না। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যরা তাদের জন্য নির্ধারিত জেলায় কার্যক্রম চালানোর প্রয়োজনীয় সুযোগ পাচ্ছেন না। সংরক্ষিত মহিলা কমিশনার ও ইউপি সদস্যরা সংশ্লিষ্ট মেয়র ও চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রত্যাশিত গুরুত্ব পাচ্ছেন না। ফলে নারী জনপ্রতিনিধিরা অনেকটাই ক্ষুব্ধ।

সংরক্ষিত ইউপি সদস্যদের ক্ষেত্রে বৈষম্যের ধরন অপেক্ষাকৃত বেশি। এ অবস্থায় প্রান্তিক পর্যায়ের এই নারী জনপ্রতিনিধিরা অনেকটা যুদ্ধ করে টিকে আছেন।

নেত্রকোনার একটি উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আফরোজা আক্তার শিমু বলেন, সরকারি বরাদ্দকৃত বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে তাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিছু ক্ষেত্রে সরকারি ১০০ কম্বল বরাদ্দ এলে তাদের চার থেকে পাঁচটি স্লিপ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ভোটে নির্বাচিত হয়েও জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারছেন না তারা। এমনকি স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তারা পুুরুষ সহকর্মীদের অবহেলার শিকার হন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের মতামতও নেয়া হয় না। কোনো কাজের উদ্যোগ নিতে গেলে নিজ দল থেকেই দলগতভাবে বাধা দেয়া হয়। 

তিনি আরও বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মর্কতারা নিজেদের পছন্দমতো তালিকা তৈরি করেন বলে নারী জনপ্রতিনিধিদের কাজের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হয়। সরকারি অনুদান ও বিভিন্ন বরাদ্দ এলে তা বণ্টনের জন্য সুবিধাভোগীদের তালিকা করবেন জনপ্রতিনিধিরা; কিন্তু এ তালিকা জনপ্রতিনিধিদের করতে না দিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা করা কতটা যৌক্তিক— প্রশ্ন এই জনপ্রতিনিধির। গত চার বছরে ৩০ ভূমিহীন পরিবারের জন্য ঘরের তালিকা দিয়ে তিনি মাত্র সাতটি ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। দু’একটি বিষয় ছাড়া উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের স্বাক্ষর দেয়ারও ক্ষমতা নেই। একই ধরনের ক্ষোভের কথা জানান কিশোরগঞ্জের একজন উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। সরকারি বরাদ্দের ক্ষেত্রে তিনিও পুরুষ সহকর্মীদের বৈষম্য তৈরির কথা বলেন। 

তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে হয়তো একসময় নারীরা রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়বেন। সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সংসদীয় এলাকার দায়িত্ব পালনে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। বিষয়টি নিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান লিটা বলেন, তাদের জন্য বছরে বিভিন্ন বরাদ্দ, টিআর (টেস্ট রিলিফ) ও কাবিখা প্রকল্পে বরাদ্দ বেশ অপ্রতুল। সোলার প্যানেল বিতরণেও কিছুটা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তারা। মূলত পুরুষ সহকর্মীরা সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করেন। আর এ কারণেই নির্ধারিত এলাকাতেও তারা মহিলা এমপিদের ভূমিকা পালন করতে দিতে চান না।

সাবেক সংসদ সদস্য মেহজাবিন খালেদ বলেন, সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের জন্য নির্ধারিত আসনে কাজ করার সুযোগ একদম সীমিত। বরাদ্দের ক্ষেত্রে তিন ভাগের এক ভাগ বা তার চেয়েও কম বরাদ্দ পান তারা।

শরীয়তপুরের একটি ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য রেহেনা আমার সংবাদকে জানান, তাদের মাত্র ৩৬০০ টাকা সম্মানি ভাতা দেয়া হয়। সারা দেশের নারী সদস্যদের একই চিত্র। এটা হতাশাজনক বলে মনে করেন তিনি।

সাবেক তথ্য কমিশনার ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম মনে করেন, গত এক দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি হয়েছে। নারীরা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসেছেন। এই কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তবে স্থানীয় সরকারে নারী জনপ্রতিনিধিদের বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার চিত্র দৃশ্যমান নয়। এর জন্য পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি অনেকাংশেই দায়ী। তাদের অলংকার হিসেবে রেখে লাভ নেই। নারী জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিতে হবে। সিদ্ধান্ত দেয়া ও নথিপত্রে স্বাক্ষর করার ক্ষমতা দিতে হবে। এজন্য পলিসি লেভেলে পরিবর্তন প্রয়োজন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা আমার সংবাদকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা। আমাদের ঘরের পুরুষরাও উদার নন। তাদের মানসিকতা উদার হতে হবে। না হলে পরিবর্তন হবে না। আমরা আশাবাদী, একটা পরিবর্তন ঘটবে হয়তো। নতুন প্রজন্মই এই পরিবর্তন ঘটাবে। তিনি বলেন, অবশ্য সরকার নানা ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।