পরিকল্পনাহীনতার মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে
—এস এম নাজের হোসেন
সহ-সভাপতি, ক্যাব
প্রতি মাসে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। দুই মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে তিনবার। প্রতিবারই খুচরা পর্যায়ে শতকরা ৫ করে বাড়ানো হয়েছে। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পণ্যের বাজারে। হু হু করে বেড়েছে গরিবের আমিষের দাম। ব্রয়লার মুরগি, ডিম, সবজিসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। অন্যান্য পণ্যের দামেও এর প্রভাব পড়ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যে ভর্তুকির কথা বলছে, বাস্তবে তা ধোপে টেকে না। কারণ, এখন জ্বালানি তেল আর গ্যাসে ভর্তুকি দিতে হয় না। বিদ্যুতে কত ভর্তুকি দিতে হয়, তা স্পষ্ট নয়। আর ভর্তুকি দিতে হলেও বিদ্যুৎ খাতে অপ্রয়োজনীয় খরচের কারণে দিতে হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় তারা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তারা জানান, বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। পণ্যের দাম বাড়লে মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দেয়। ব্যবসা কম হলেও দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ আনুষঙ্গিক খরচ কমে না, বরং ব্যয় বেড়ে যায়। এতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। গতকাল বুধবার রাজধানীর কয়েকটি বাজারে গিয়ে জানা গেছে, মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে দিগুণ। কারওয়ান বাজারে খবর নিয়ে জানা যায়, দুই মাস আগেও ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হয়েছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। সেই মুরগির রেকর্ড দাম বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায়।
সোনালি মুরগির দামও কেজি ৩৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে দেশি মুরগিও। বিক্রেতারা বলছেন, এর আগে কখনোই তারা ২৬০ টাকা কেজিতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেননি। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়ে গেছে অনেক। যার ফলে পাইকারি আড়ৎদারদের বেশি দামে কিনতে হয়। ফলে খুচরা বাজারেও উল্লম্ফন গতিতে বেড়ে গেছে মুরগির দাম। এছাড়া খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ব্রয়লার মুরগির সরবরাহ কমে গেছে। যার ফলে রেকর্ড দাম সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান কারওয়ার বাজারের এক ব্যবসায়ী।
রাজধানীর ফকিরেরপুল বাজারের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, শীতের সময় সাধারণত ব্রয়লারের দাম কম থাকে। কিন্তু এবার বেশি। বিদ্যুৎ ছাড়া খামার কল্পনা করা যায় না। বিদ্যুতের দাম বাড়লে খামারিদের খরচ বাড়ে। এ কারণে তারা দাম বাড়ান। বাজারের ডিম ব্যবসায়ী রহিম মিয়া জানান, সপ্তাহখানেক আগেও ডিম প্রতি ডজন ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন প্রায় ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারে দৈনিকই বাড়ছে দাম। সবজি ব্যবসায়ীরা জানান, বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। শ্রমিকরা আগের মজুরিতে কাজ করছে না। এছাড়া পরিবহন খরচ বেড়েছে অনেক। তাই আমরা বাধ্য হয়ে সবজির দাম বৃদ্ধি করেছি। নতুন করে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়ে হাতিরপুল বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, বিদ্যুতের সঙ্গে সব কিছুরই সম্পর্ক আছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও একইভাবে বেড়েই চলছে। আর এখন তো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে। তিনি বলেন, দাম বাড়লে মানুষ কম পরিমাণে কেনে। বিক্রি কমে গেলে লাভের পরিমাণও কমে। কিন্তু দোকানের অন্যান্য খরচ কমে না।
বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ আলী আমার সংবাদকে বলেন, বিদ্যুতের দামের সঙ্গে অন্য জিনিসের দামও বাড়ে। আমার সীমিত আয়ে সংসারে অভাব অনটন থেকেই যায়। এখন নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। আমাদের মতো কম আয়ের মানুষদের এখন না খেয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। আমার সীমিত আয়ে এখন জিনিসপত্রের ব্যবহার কমিয়ে দিতে হবে। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা রতন মল্লিক জানান, আমার মাসিক দুই হাজার ৫০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল তিন হাজার ৫০০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার পরিবার চালাতে হিমশিম অবস্থার মধ্যে পড়ে যাব। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বাচ্চার স্কুল খরচ কীভাবে যে চালাবো জানি না। অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, আমার দীর্ঘদিনের এক প্রতিবেশী শহর জীবনের খরচ চালাতে না পারায় স্ত্রী, সন্তানসহ গত মাসে গ্রামে চলে গেছে। এভাবে অনেকেই যাচ্ছে। আবার অনেকে খরচ কমানোর জন্য পরিবার গ্রামে রেখে আসছে। তিনি আরেকটু যুক্ত করে বলেন, মন্ত্রীরা এখনো বিদ্যুতের দাম সহনীয় বললেও আমার মতো যারা (স্বল্প আয়ের মানুষ) আছেন তাদের জন্য এটা কোনোভাবেই সহনীয় নয়। আমরা আসলে আরও চাপের মুখে পড়লাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নে সরকার একের পর এক পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়িয়ে চলছে। আগে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া থেকে হতদরিদ্র ও কৃষি-সেচকে বাদ রাখা হলেও এখন সেখানেও হানা দেয়া হচ্ছে।
গত সাত মাসে আটবার বাড়ানো হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেল ও সারের দাম, যার প্রভাবে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম ঊর্ধ্বমুখী। একদিকে টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যয়ভারে সংকুচিত হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন, যা মোটেই কাম্য নয়। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, এমনিতেই আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আছি। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এটা আরও বাড়ছে। যার চাপ বহন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের। এসএস নাজের হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ খাতে অপচয়, অব্যবস্থাপনা দূর করতে পারলে দাম বাড়ানোর দরকার হতো না। আসলে দুর্নীতি ও পরিকল্পনাহীনতার মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।