বিশ্ব কিডনি দিবস আজ
ভয়াবহ আকারে বাড়ছে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগী। এক পর্যালোচনার তথ্যমতে, দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে ভুগছেন। সেই হিসেবে দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগাক্রান্ত। দীর্ঘমেয়াদি এসব কিডনি রোগীর শেষ চিকিৎসা নিয়মিত ডায়ালাইসি অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের পক্ষে এই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিডনি দাতা, সামাজিক সচেতনতা কিংবা দক্ষ জনবলের অভাবে প্রতিস্থাপনও তেমন হচ্ছে না। ফলে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ কিডনি রোগীকে মৃত্যুর কাছে হেরে যেতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অনেকদিন উপসর্গ বিহীন থাকতে পারে। অনেক সময় ৯০ শতাংশ কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াপর পর উপসর্গ প্রকাশ পেতে পারে।
এক্ষেত্রে কিডনি রোগ প্রতিরোধকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। একেই সঙ্গে স্টেম সেল থেরাপিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেজার সার্জারি ও হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ লেজার অ্যান্ড সেল সার্জারি ইনস্টিটিউটে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের চিকিৎসায় স্টেম সেল প্রয়োগ করছেন। তাদের দাবি মতে, স্টেম সেল প্রয়োগের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে আক্রান্ত কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। ৭৭ জন দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগীর ওপর এই গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে ইতোমধ্যে তারা সক্ষমতা পেয়েছেন। এই চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়মিত ডায়ালাইসিসের তুলনায় চিকিৎসা ব্যয়ও কমিয়েছে।
এই স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। স্টেম সেল বিশেষজ্ঞ ও বিএলএস হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী বলেন, অকেজো কিডনির কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক আবিষ্কার স্টেম সেলভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। স্টেম সেল সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকে। ভ্রণ স্টেম সেল এবং পরিণত স্টেম সেল। বোনমেরু, হাড়, চর্বি এবং মাংসপেশীসহ মানবদেহের বিভিন্ন টিস্যু থেকে পরিণত স্টেম সেল পাওয়া যায়। কিডনিরচিকিৎসায় চর্বিও কোষ থেকে উৎপন্ন মেসনকাইম্যাল স্টেম সেল ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, এ ধরণের স্টেম সেল শরীরের অকেজো হয়ে যাওয়া রক্তনালী সচল করা, ক্ষত সারানো, ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু পুনরুজ্জীবীত করা, স্বাস্থ্যকর নাইট্রিক অক্সাইড রিসেপটর ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখতে পারে। দূরারোগ্য বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল চিকিৎসার পরিবর্তে স্টেম সেল বেজড চিকিৎসা এখন অনেক বেশি সফলতা প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি ১০ জনের একজন ক্রনিক কিডনি ডিজিস বা দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগে ভুগছেন। তবে বয়স্কদের মধ্যে এই হার আরও বেশি। ৬৫ থেকে ৭৫ বছর বয়সি প্রতি ৫ জনে একজন পুরুষ এব প্রতি চারজন নারীর একজন দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগে ভুগছেন। আর ৭৫ তদুর্ধ মানুষের অর্ধেক কিডনি রোগে ভুগছেন। ইউনাইটেড স্টেট রেনাল ডাটা সিস্টেমের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে এন্ড স্টেজ রেনাল ডিজিস (ইএসআরডি) রোগীর সংখ্যা ছিলো প্রতি ১০ লাখে ১০৯ জন।
২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের এই এক দশকে ইএসআরডি রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় আড়াইগুণ। ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত নেফ্রোলডি ওয়ার্ল্ডওয়াইড গ্রন্থেও তথ্যমতে, ২০২০ সালে দেশে ১০ হাজার ৮৪১ জন মানুষ কিডনি রোগে মারা গেছেন। ঐ গ্রন্থে নেফ্রোলজি ইন বাংলাদেশ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয় দেশের দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগীর মাত্র মাত্র ২৫ ভাগ রেনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (আরআরটি) বা প্রতিস্থাপন অথবা ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণ করতে পারেন। এর কারণ হিসেবে প্রবন্থে বলা হয়েছে, কিডনি রোগের চিকিৎসা উচ্চ ব্যয়ভার, সারা দেশে কিডনি রোগের অপ্রতুল চিকিৎসা সুবিধা এবং প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টেও অভাবকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে ১৪টি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ২৬৩টি ডায়ালাইসিস শয্যা রয়েছে। ডায়ালাইসিস সেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ২২টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট ডায়ালাইসিস ইউনিট ও ৪৪টি জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিটে এক হাজার ৫৪০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্ত। ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৯০০ জন রোগীর নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিচ্ছিলেন। তবে বিশাল একটা অংশ আর্থিক সংকটে ডায়ালাইসিস সেবা নিতে পারছেন না। আর এর ফলে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে তারা। প্রতিবছর নতুন করে কিডনি রোগী যোগ হয় এক হাজার জন। এ সংখ্যা মোট আক্রান্তের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
এছাড়া বাকি কিডনি রোগে আক্রান্ত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। তার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। বাংলাদেশে এতো মানুষকে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়াও সম্ভব না। সবাইকে এ সেবার আওতায় নিতে স্বাস্থ্যসেবায় আরও পাঁচগুণ বেশি বাজেট প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, নিম্ম ও মধ্যম আয়ের দেশের অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা কিংবা প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম নন। আবার দেশের প্রতি ১৫ লাখ মানুষের জন্য রয়েছেন মাত্র একজন নেফ্রোলজিস্ট। আর কিডনি প্রতিস্থাপনের সক্ষমতা আছে মাত্র ২৫ জনের। জাতীয় কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা দাতা স্বল্পতা। আবার জনবল ঘাটতিও রয়েছে।
তবে এরমধ্যেও আমাদেও পরিকল্পনা রয়েছে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুইটি কিডনি প্রতিস্থাপন করার। তবে এভাবে প্রতিস্থাপন এই রোগের সমাধান নয়। কিডনি রোগের ঝুঁকি কমাতে আমাদেও দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম ও নিজেকে সক্রিয় রাখতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পরিমিত পানি পান করতে হবে। ধুমপান পরিহার করতে হবে। সেইসাথে নিজের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন পরিহার করতে হবে।