ইস্যু রেশ কাটছেই না। সিরিজ বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ডের পর প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে ব্যাংক ও পেট্রোল পাম্পের টাকা ছিনতাইয়ের আড়ালে দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অন্য কিছু দেখছেন। গতকাল রাজধানীর উত্তরায় প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে একটি ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে ডাকাতরা। একই দিন দুপুরে মানিকগঞ্জে পেট্রোল পাম্প মালিকের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই করা হয়। গত মঙ্গলবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় আরেকটি ডাকাত চক্র। ধারাবাহিক এসব ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ছিনতাই বলছেন না বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য জননিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলার চেষ্টা হতে পারে। কেউ আড়াল থেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মদত দিয়ে এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। এতে দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি নষ্ট হওয়ার শঙ্কা দেখা দিতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, অতীতে এমন ইস্যুভিত্তিক সিরিজ ঘটনায় পর্দার আড়ালে অন্য কিছুও ঘটেছে। নাগরিক দৃষ্টি অন্যদিকে ব্যস্ত রেখেছে একটি অংশ। এ কারণে সমপ্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে সরকারকে জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ আমার সংবাদকে বলেছেন, যেভাবে ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে এতে জননিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের ঘটনা মানুষের মনে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারাবাহিক এসব ঘটনার পেছনে অন্য কারো মদত রয়েছে কি-না সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিত হতে হবে। কারণ, আমরা জানি সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হতে পারে। রাজনীতির আড়ালে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে।
দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করার জন্য কিছু গোষ্ঠী উদ্দেশ্য নিয়ে তৎপর হতে পারে। দেশে অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা মানুষের জীবনকে হুমকিতে ফেলে বড় ধরনের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা হতে পারে। সমপ্রতি বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ড এমনকি ধর্মীয় ইস্যুতে নানা ঘটনার পেছনে অন্য কিছু রয়েছে কিনা সেগুলো খুঁজে দেখা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন এই বিশ্লেষক। একই সঙ্গে রাজধানীর উত্তরা-মানিকগঞ্জসহ দেশজুড়ে যেসব ডাকাতির ঘটনা ঘটছে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইসফাক এলাহী আমার সংবাদকে বলেছেন, যেভাবে দেশজুড়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে এটি অবশ্যই বড় ধরনের দুশ্চিন্তার ব্যাপার। এটি কি অপরাধী চক্রের দ্বারা সংগঠিত হচ্ছে নাকি ছিনতাই চক্র। যদি অপরাধী চক্রের দ্বারা গঠিত হয় তাহলে এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সমপ্রতি ঘটে যাওয়া সব ইস্যুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সতর্কতার সাথে দেশজুড়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। উত্তরায় ব্যাংকের ডাকাতির সাথে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তদন্ত করতে হবে। অবশ্য সরকারকে আরও নজর দিতে হবে। ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো বিশৃঙ্খল নাকি কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা সম্পাদিত হচ্ছে তা দেখতে হবে।
অস্ত্র ঠেকিয়ে ডাচ্?-বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা ডাকাতি : রাজধানীর উত্তরায় প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে বেসরকারি ডাচ্?-বাংলা ব্যাংকের গাড়ি থেকে সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে ডাকাতরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার, ওসিসহ ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চলে পুলিশের তল্লাশি। তুরাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, সকালে রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএসের সিকিউরিটি কোম্পানি মানি প্ল্যান্টের গাড়িতে করে সোয়া ১১ কোটি টাকা নিয়ে সাভারের ইপিজেডে ডাচ্?-বাংলা ব্যাংকের বুথে নিয়ে যাচ্ছিল।
সকাল ৭টার দিকে আড়াআড়ি করে মাইক্রোবাস দাঁড় করিয়ে উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর ব্রিজসংলগ্ন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহন করা গাড়িটির গতি রোধ করে। মাইক্রোবাস থেকে ১০-১২ জন সশস্ত্র ডাকাত নেমে টাকা বহন করা গাড়ির দরজা ভেঙে অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে সোয়া ১১ কোটি টাকা ভর্তি ট্রাংক ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। তবে এতে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ টাকা বহন ও এটিএম বুথে জমার দায়িত্ব নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের। আবার এই টাকা বিমার আওতায় রয়েছে। ফলে এ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’
ছিনতাই হওয়া টাকার মধ্যে ৯ কোটি উদ্ধার : রাজধানীর উত্তরায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ছিনতাই হওয়া সোয়া ১১ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৯ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ডিবি জানায়, ছিনতাই হওয়া টাকাভর্তি চারটি ট্রাংকের মধ্যে তিনটি উদ্ধার করা হয়েছে। টাকা পরিবহনে নিয়োজিত মানি প্ল্যান লিংক সিকিউরিটিজ কোম্পানি লিমিটেডের দুজন পরিচালক ও গাড়িচালকসহ সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটিকে পরিকল্পিত ঘটনা বলছে ডিবি। ছিনতাইকারীরা অনেক আগে থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছিল বলেও জানায় ডিবি।
মানিকগঞ্জে দিনে-দুপুরে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই : মানিকগঞ্জে দিনে-দুপুরে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সিংগাইর আঞ্চলিক সড়কের নয়াকান্দি ব্রিজের কাছে এক পেট্রোল পাম্প মালিকের কাছ থেকে টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় দুজনের নামসহ ওই ব্যবসায়ী পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
মিতরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে মিলন্স ফিলিং স্টেশনের মালিক সোহবার হোসেন জানান, পাম্পের তেল বিক্রির ১৫ লাখ টাকা ব্যাংকে রাখার জন্য সকালে তিনি মোটরসাইকেল যোগে মানিকগঞ্জ শহরে যাচ্ছিলেন। তাকে বহনকারী মোটরসাইকেলটি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মানিকগঞ্জ-সিংগাইর আঞ্চলিক সড়কের নয়াকান্দি ব্রিজের কাছে পৌঁছলে তিনটি মোটরসাইকেল করে পাঁচ-ছয়জন ছিনতাইকারী যানটির গতিরোধ করে। এরপর তাকে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে তিনি মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গেলে তার কাছে থাকা ১৫ লাখ টাকাসহ ব্যাগটি নিয়ে ছিনতাইকারী পালিয়ে যায়।
সোহবার হোসেন আরও জানান, ছিনতাইকারীদের মধ্যে দুজনকে তিনি চিনতে পেরেছেন। তারা হলেন— সদর উপজেলার বড় সরুন্ডী গ্রামের আ. রশিদের ছেলে মো. জিসান (২৩) ও একই গ্রামের মো. রহিজ উদ্দিদের ছেলে মো. রবিউল ইসলাম। সদর থানার ওসি আব্দুর রউফ সরকার জানান, টাকা ছিনতাই ঘটনায় পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ব্যবসায়ী অভিযোগ আমলে নিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার ও ছিনতাই হওয়া টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।