নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এজেন্সি উন্মুখ —বলছেন সরকারপ্রধান
রাজনীতিতে হঠাৎ আলোচনার শীর্ষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সম্ভাব্য এ নির্বাচন কেমন হবে। অংশগ্রহণমূলক হবে কী না। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, নির্বাচনে কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কী না— এমন নানা বিষয় নিয়ে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, বিদেশি কূটনীতিকরা সরব। এমনকি আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রতিনিয়ত নির্বাচন নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন। গতকাল তিনি বলেছেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এজেন্সি উন্মুখ হয়ে আছে। নির্বাচন যাতে অবাধ-সুষ্ঠু হয়, তার জন্য নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় সংশোধনী বা সংস্কার আনা হয়েছে। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি সাফ জানিয়েছে দিয়েছে তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।
আওয়ামী লীগও বর্তমান সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো নির্বাচনি প্রক্রিয়ার কথা ভাবছে না। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে চায় তারা। এ অবস্থায় দেশের সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে সে সম্পর্কে ধারণা নিতে বেশ তৎপরতা দেখাচ্ছে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকরা। সব শেষ গত রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিনিধি দল। তারা নির্বাচন কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছেন নির্বাচনটা আসলে কেমন হবে। বিশেষ করে এই প্রতিনিধি দল জানতে চেয়েছে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কী না। কমিশন এক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করবে। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি দলকে ইসি সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার জন্য কোনো উদ্যোগ নেবে না। তবে কমিশন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা করছে।
বছরের প্রথম দিকেই নির্বাচন কমিশনে বিদেশি কূটনীতিকদের আনাগোনা শুরু হয়। গত ১৮ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সম্ভাব্য নির্বাচনে ভোটের সার্বিক প্রস্তুতির খবর জানতে চান সিইসির কাছে। ওই সময় তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কাছে জানতে চেয়েছিল, সব দল নির্বাচনে আসবে কি না, ইভিএমের ওপর দলগুলো আস্থা রাখছে কি না? তারও আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন ও রাষ্ট্রদূতরা গত বছর জুলাইতেও ইসিতে এসেছিলেন। জানুয়ারিতে (১৮ জানুয়ারি) ইইউকে সিইসি হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছিলেন, ইসি আশা করে অচিরেই মতপার্থক্যটা দূর হয়ে যাবে। শেষমেষ সব দল নির্বাচনে আসবে, সে বিষয়ে ইসি আশাবাদ ব্যক্ত করে সিইসি তখন বলেন, তারা নিশ্চিত যদি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়, তাহলে চমৎকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। সেই লক্ষ্যে ইসির পুরো প্রস্তুতি রয়েছে বলেও ইইউকে জানানো হয়।
এদিকে গত ১২ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ের, দেশটির পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য দপ্তরের উত্তর ও দক্ষিণ এশিয়ার সহকারী সচিব (প্রথম) গ্রে কোওয়ান, সহকারী পরিচালক এলিস হেইনিঙ্গার এবং হাইকমিশনের উপপ্রধান নার্দিয়া সিম্পসন নির্বাচন কমিশনে যান। তারা সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি দল ইসির সঙ্গে আলোচনার সময় ‘আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চাই’ বলে জানায়। এ প্রসঙ্গে সিইসি সাংবাদিকদের জানান, ‘উনারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হবে, ট্রুথফুল হবে। আমরা প্রিপারেশনের কথা জানিয়েছি। আমরা ফুললি প্রিপেয়ার্ড। আমরাও চাচ্ছি অংশগ্রহণমূলক হোক, কনটেস্টেড হোক।’ অস্ট্রেলিয়া জানতে চেয়েছে রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো উদ্যোগ ইসি নেবে কিনা, বা রাজনৈতিক দলের সমঝোতার সৃষ্টি করার উদ্যোগ ইসি নিতে পারে কি না? ইসি অস্ট্রেলিয়াকে জানিয়েছে ‘এটা ইসির দায়িত্বের পরিধিভুক্ত নয়।’
গত ১৮ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে আগামী নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক, এটাই চেয়েছিল ইইউর প্রতিনিধি দল। তখন ইইউর প্রতিনিধি দল নির্বাচনি পর্যবেক্ষক ও কারিগরি সহযোগিতার কথা ইসিকে জানায়। আমাগী নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চায় ২৭ দেশের এই জোট, এজন্য গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চিঠি লিখে জানায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনকে। ওইদিনই ঢাকার ইইউ প্রধানসহ জোটের অন্যান্য রাষ্ট্রদূতরা বৈঠক করে আওয়ামী লীগের সাথে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার বিএনপির সাথে বৈঠক করেছে ইইউ। গত ১২ মার্চ ইইউ ডেলিগেশনের প্রধানের বাসায় হওয়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন— জোটের অন্যান্য রাষ্ট্রদূত। যেখানে নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন ইইউ প্রধান। শোনেন বিএনপির কথাও। ইইউ ডেলিগেশন প্রধান জানান, আগামীতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করবেন তারা।
এদিকে আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণে নির্বাচন কমিশনে (ই?সি) আবেদন করেছে ২১০টি সংস্থা। যাচাই-বাছাই শেষে যোগ্য হলে নিবন্ধিত সংস্থাগুলো আগামী পাঁচ বছরের জন্য সংসদ ও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবে। ইসি সূত্রে জানা গেছে, গত ২ ফেব্রুয়ারি ছিল আবেদনের শেষ সময়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ১৯৯টি এবং নির্ধারিত সময়ের পর আরও ১১টি সংস্থা আবেদন করেছে। ইসির সংশ্লিষ্ট শাখায় গত সপ্তাহে পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন আবেদন যাচাই-বাছাইয়ে একটি সভা হয়েছে। সবগুলো আবেদনের যাচাই-বাছাইয়ে আরও প্রায় তিন সপ্তাহ লাগতে পারে। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর দাবি-আপত্তি জানতে ১৫ দিন সময় দিয়ে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। আবেদনকারী কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে কমিশন শুনানি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাবে। জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালে ১১৯টি সংস্থাকে পাঁচ বছরের জন্য নিবন্ধন দিয়েছিল তৎকালীন কে এম নূরুল হুদা কমিশন। ২০১১ সালে ১২০টি পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেয়া হয়। ২০০৮ সালে ১৩৮টি সংস্থাকে নিবন্ধন দেয় তৎকালীন এটিএম শামসুল হুদা কমিশন।