শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় পদক্ষেপ নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে
—ড. মীজানুর রহমান, সাবেক ভিসি, জবি
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা জোরদারে আমরা কাজ করছি—ড. গোলাম সাব্বির, ভিসি, রাবি
নিরাপত্তার জন্য শতভাগ আবাসন সুবিধা থাকা প্রয়োজন—ড. মো. অধ্যাপক ছাদেকুল আরেফিন, ভিসি, ববি
দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান শহর থেকে দূর প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কদিন পরপর স্থানীয় লোকজন ও বখাটেদের হাতে নির্যাতনের শিকার হন। ক্যাম্পাসগুলোতে নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে মনে করছেন অনেকে। বলা যায়, প্রায় সব ক্যাম্পাসই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এমন সুযোগে বখাটেরা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করার সুযোগ পাচ্ছে। আবাসিক সুবিধা নেই ৪৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর। এদের থাকতে হচ্ছে মেস-বাসায়।
ফলে মেস মালিকদের কাছেও অনেকটা জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। খাবারের জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে বাইরের হোটেলের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ বলছে, নিরাপত্তার জন্য শতভাগ আবাসন সুবিধা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটা আমরা চাইলেও রাতারাতি পাওয়া সম্ভব নয়। অন্য দিকগুলোও সংশোধনের কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শতভাগ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা, ক্যাম্পাসের চারপাশে দেয়াল নির্মাণ, ক্যাম্পাসের ভেতরে শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করা, স্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্থানীয় নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর ওপর জোর দিতে হবে।
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও বাস হেলপারের সঙ্গে বািবতণ্ডার ঘটনায় সংঘর্ষে জড়িয়ে যায় স্থানীয়রা। সংঘর্ষে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। গত ২ ফেব্রুয়ারি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে চার শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন।
দেশের প্রায় সবগুলো ক্যাম্পাসে যে কোনো সময়ই বহিরাগতরা প্রবেশ করতে পারে। ক্যাম্পাসে তাদের উৎপাত যেন থেমে নেই। গত ১৬ জানুয়ারি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) শেখ হাসিনা হলের পেছনে আপত্তিকর অবস্থায় দুই যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতার বেশ কয়েকটি সংবাদ গণমাধ্যমে এলেও এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা দুই লাখ ৮৯ হাজার ৬৪৫ জন। তাদের মধ্যে আবাসন সুবিধা পায় এক লাখ চার হাজার ৮৫২ জন। এর মধ্যে আবাসন সুবিধাবঞ্চিত প্রায় ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।
ক্যাম্পাসগুলোর খাবারের মান নিয়েও শিক্ষার্থীদের রয়েছে নানা অভিযোগ। ফলে বাইরের হোটেলে খেতে বাধ্য হন তারা। সেখানে হোটেল মালিক বা কর্মচারীদের কাছ থেকেও নানা দুর্ব্যবহারের শিকার হন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়াও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই পর্যাপ্ত ক্যান্টিন সুবিধা। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্টিনে খাবারের মান খারাপ থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাইরের হোটেলে খান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী জন্য রয়েছে একটি মাত্র ক্যান্টিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কজন শিক্ষার্থী খাবারের মান নিয়ে নানা অভিযোগ জানিয়েছেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক এক ঘটনার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা জোরদারে আমরা কাজ করছি। আমরা স্থানীয়দের সঙ্গে বসেছি। মেস মালিকদের সঙ্গেও কথা বলেছি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশে আমরা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছি। ক্যাম্পাস গেটে নিরাপত্তা বাড়িয়েছি। শতভাগ আবাসন সুবিধা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রজেক্ট। আমাদের দুটি হল তৈরি হচ্ছে। এর মাধ্যমে আবাসন ঘাটতি কিছুটা হলেও কমবে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. অধ্যাপক ছাদেকুল আরেফিন বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের নিয়ে বেশ কিছু সমস্যায় ছিলাম। ইতোমধ্যে সেগুলো দূর করেছি। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য শতভাগ আবাসন সুবিধার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. মীজানুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে কোনো অনুষ্ঠানে স্থানীয় নেতাদের আমন্ত্রণ জানাতে পারে। প্রয়োজনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের মেহমান হিসেবে রাখা যেতে পারে। তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য চেষ্টা করতে হবে।
তাদের বোঝাতে হবে, এটা তাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়। এর নিরাপত্তার দায়িত্বও তাদের। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শতভাগ আবাসিক করতে হবে। ক্যাম্পাসের ভেতরে সব ধরনের দোকান রাখা যেতে পারে। যাতে শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন না হয় এবং চারদিকে দেয়াল নির্মাণ করতে হবে।
টিএইচ