স্মার্ট বাংলাদেশ নাগরিকদের ডিজিটাল সেবা ও প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার প্রদান করে, জনসেবা প্রদানের উন্নতি সাধন করে এবং ডিজিটাল অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতায় তাদের সজ্জিত করে। এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে আগামীর কৃষি ও কৃষককে স্মার্ট করতে কৃষি মন্ত্রণালয় ও এর সব অধিদপ্তর সংস্থাকে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নিতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা উইং ও শাখাকে। স্মার্ট ফারমিং কিংবা কৃষিতে ডিজিটালাইজেশন, কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমপ্রসারণ, স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে ফসল এবং চারণভূমির স্বাস্থ্য নির্ধারণ, কীটপতঙ্গ এবং রোগ শনাক্তকরণ, কৃষিকে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধদীপ্ত প্রযুক্তি ভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার এখনই সময়
২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস ২০২২’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন ‘আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করব এবং সেটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ।’ তার সেই দ্বার্থহীন কণ্ঠের ঘোষণা সূচনা করে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। একটি স্মার্ট দেশ মানে যে দেশের মানুষ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ডেটা বা তথ্য নির্ভর সহজপ্রাপ্য, আধুনিক উদ্ভাবনী ধারণাসম্পন্ন, অংশগ্রহণমূলক প্রত্যাশিত সরকার, যা নাগরিকদের চাহিদাগুলোকে আরও ভালোভাবে পরিবেশন করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতায়িত হয়।
ডিজিটাল বাংলাদেশের দর্শনের মধ্যে ছিল জনগণের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে সরকারি সেবা প্রদান নিশ্চিত করা, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সার্বিক উন্নয়ন। আর এবারের স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিক হবে প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ, প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে, সরকার হবে (প্রযুক্তিগতভাবে) স্মার্ট।
একটি স্মার্ট দেশে, আমরা প্রধান ডোমেনে পরিবর্তনগুলো মূলত দেখতে পাব— অর্থ, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবহন, শহুরে সমাধান এবং শিক্ষা খাতগুলোতে। উদাহরণস্বরূপ, সেন্সর এবং স্মার্ট সিস্টেমের ব্যবহারে আমাদের বাড়ি এবং এস্টেটগুলো নিরাপদ ও আরও আরামদায়ক এবং টেকসই হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন স্মার্ট বাংলাদেশ ইকোসিস্টেম চারটি মূল স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি এবং স্মার্ট ইকোনমি। এখন স্মার্ট গভর্নমেন্ট যদি বাদও দেই, বাকি তিনটির প্রত্যেকটি পিলার বা স্তম্ভকে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে স্মার্ট কৃষি ও স্মার্ট কৃষকের কোনো বিকল্প নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টির আর একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হলো— তিনি এই স্মার্ট কৃষি ও স্মার্ট কৃষকের ভাবনা পোষণ করেছিলেন সেই ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে। ‘কৃষি বাতায়ন’ নামে একটি সফটওয়ার নির্ভর পোর্টাল ও ‘৩৩৩১’ নামক কৃষকের ফোন সেবার উদ্বোধনকালে তিনি ঘোষণা দেন, ‘প্রত্যেক কৃষকের দোরগোড়ায় কৃষিসেবা সহজে পৌঁছে দিতে ‘কৃষি বাতায়ন’ তৈরি করা হচ্ছে। কৃষি বাতায়নে সারা দেশের কৃষকদের ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে দেশের ৩ কোটি কৃষককে ডিজিটাল ডাটাবেজের আওতায় আনা হবে। কৃষকের জন্য ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে।’
তার সেই ঘোষণার ধারাবিকতায় ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল প্রশাসনিক অনুমোদন নিয়ে যাত্রা শুরু করে স্মার্ট কৃষি কার্ড ও ডিজিটাল কৃষি (পাইলট) প্রকল্প। এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, কৃষকের ডিজিটাল পরিচিতি হিসেবে স্মার্ট কৃষিকার্ড ব্যবহার করে প্রতিটি কৃষকের জন্য এলাকা ও চাহিদা ভিত্তিক কৃষি সেবা প্রদান এবং কৃষি তথ্যের ডিজিটাল বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কৃষি তথ্যের আদান প্রদান নিশ্চিত করা। আর এই প্রকল্পের মাধ্যমে আবহমান বাংলার কৃষি ও কৃষকের স্মার্ট কৃষিতে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল। আর এ থেকেই বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতখানি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন রাষ্ট্রপরিচালক। জয়তু শেখ হাসিনা।
এই প্রকল্পটি হতে এক কোটি ৬২ লাখ কৃষকের ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি এবং ১ কোটি ৯ লাখ কৃষককে স্মার্ট কৃষিকার্ড প্রদান করা হবে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে। এ বছর ২০২৩ সালের মধ্যে এই কাজের উদ্বোধন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ডিজিটাল উপায়ে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষকের সাথে সমপ্রসারণ কর্মী ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের যোগাযোগ, তথ্যের আদান প্রদান ও এলাকা ভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে এই প্রকল্পটির মাধ্যমে। ডিজিটাল কৃষি তথ্যের সাহায্যে ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা ও বাজারজাতকরণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কৃষকপর্যায়ে ৩০% সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ট্রেসিবিলিটি নির্ণয় ১৫% বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা রয়েছে এই প্রকল্পে। পাশাপাশি নারী কৃষক ও নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল সচেতনতা ও দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করাও এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। এক কথায় ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল কৃষি ও কৃষককে স্মার্ট কৃষি ও স্মার্ট কৃষক হিসেবে পরিণত করতে সূচনা কর্ম এই প্রকল্পেই নিহিত।
চিত্র: প্রাথমিকভাবে স্মার্ট কৃষিকার্ড বিতরণ হবে দেশের ৯টি জেলার ৭৫টি উপজেলায়
‘স্মার্ট সিটিজেনের লক্ষ্য হবে ডিজিটাল ফার্স্ট মানসিকতার ড্রাইভিং প্রচারাভিযান এবং ব্যাপক ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের ক্ষমতায়ন করা। আর এক কোটি ৬২ লাখ কৃষি পরিবারকে ‘স্মার্ট সিটিজেন’ না বানাতে পারলে, স্মার্ট সোসাইটি যেমন তৈরি হবে না, স্মার্ট বাংলাদেশও তেমনি গঠন হবে না।
২০২২ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে চারটি পঞ্চবার্ষিকী পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পায়নের মাধ্যমে যেমন উচ্চআয়ের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে রয়েছে, তেমনি খোরপোষের কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরের লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে এই পরিকল্পনাগুলোতে। এই উদ্যোগ বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বিকাশের জন্য উৎপাদন ক্ষমতা সমপ্রসারণ এবং মানব পুঁজি উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে।
কৃষি মন্ত্রণায়লের অধীন কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর গেল বছর নেদারল্যান্ডের আলমেইরে আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার এক্সপোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইউরোপের কৃষি বাজারে বাংলাদেশি কৃষি পণ্য, বিশেষ করে পাট ও পাটজাতদ্রব্য প্রদর্শন করে ব্যাপক সাড়া পেয়েছিল। সমপ্রতি পাট ও পাটজাত দ্রব্যকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করায় বৈদেশিক বাজারে কৃষিপণ্যের বিনিয়োগ সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট কৃষি বিনির্মাণে এখান থেকেই হতে পারে সূত্রপাত।
এ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা আর একটি দূরদর্শিতার প্রমাণ বহন করে। অপরদিকে স্মার্ট ইকোনমি হলো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, সম্পদের দক্ষতা, স্থায়িত্ব এবং উচ্চ সামাজিক কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে একটি অর্থনীতি। স্মার্ট ইকোনমি উদ্ভাবন, নতুন উদ্যোক্তা উদ্যোগ গ্রহণ করে, সব নাগরিকের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার সামগ্রিক লক্ষ্যের সাথে উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতা বাড়ায়। আর এই প্রতিযোগী সমাজে কৃষি ও কৃষককে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। এখন চাই তথ্যসমৃদ্ধ দক্ষতা সম্পন্ন স্মার্ট কৃষক।
যে কৃষক মাঠে আর লাঙ্গল বইবে না, চালাবে আধুনিক কৃষি যন্ত্র ট্রাক্টর কিংবা কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর। যে কৃষকের হাতে থাকবে স্মার্ট কৃষি কার্ড, যার মাধ্যমে সে যেমন গ্রহণ করবে সব সরকারি কৃষি সহায়তা, প্রণোদনার বীজ ও সার, তেমনি এই স্মার্ট কৃষি কার্ড হাতে চলে যাবে সুপার সপে দৈনন্দিত বাজার-সদাই করতে অথবা এটিএম বুথে ব্যাংকিং সেবা নিতে, টাকা তুলতে। হাড্ডি-কংকালসার কৃষকের পরিবর্তে সুঠাম দেহের পরিপাটি স্মার্ট কৃষকের স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আইজিআই গ্লোবাল স্মার্ট গভর্নেন্স বা স্মার্ট ই-গভর্নেন্সকে শাসক সংস্থার মধ্যে উন্নত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিকল্পনাকে সহজতর ও সমর্থন করার জন্য প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের ব্যবহার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। স্মার্ট বাংলাদেশ নাগরিকদের ডিজিটাল সেবা ও প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার প্রদান করে, জনসেবা প্রদানের উন্নতি সাধন করে এবং ডিজিটাল অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতায় তাদের সজ্জিত করে।
এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে আগামীর কৃষি ও কৃষককে স্মার্ট করতে কৃষি মন্ত্রণালয় ও এর সব অধিদপ্তর সংস্থাকে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নিতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা উইং ও শাখাকে। স্মার্ট ফারমিং কিংবা কৃষিতে ডিজিটালাইজেশন, কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমপ্রসারণ, স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে ফসল এবং চারণভূমির স্বাস্থ্য নির্ধারণ, কীটপতঙ্গ এবং রোগ শনাক্তকরণ, কৃষিকে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধদীপ্ত প্রযুক্তি ভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার এখনই সময়।
তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কৃষক কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষতি ও বর্ধিত খরচ রোধ করতে সময়োপযোগী লক্ষ্যযুক্ত কৌশল বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় এমন প্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখেছেন, আসুন তা বাস্তবায়নে আমরা সচেষ্ট হই, গড়ে তুলি স্মার্ট কৃষি ও স্মার্ট কৃষকসমাজ ভিত্তিক এক স্মার্ট বাংলাদেশ।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক, স্মার্ট কৃষিকার্ড ও ডিজিটাল কৃষি (পাইলট) প্রকল্প, কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।