দুদিনের লঙ্কাকাণ্ডে ভোট শেষ

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৩, ১১:২৫ এএম
  • প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই —অ্যাটর্নি জেনারেল
  • দুদিনে ভোট দিয়েছেন চার হাজার ১৩৭ জন বিরত ছিলেন চার হাজার ৪৬৫ জন
  • বিএনপিপন্থিদের অংশগ্রহণ ছাড়াই দ্বিতীয় দিনে ভোট গ্রহণ 
  • সুপ্রিম কোর্টের ঘটনায় আইনজীবী রিমান্ডে

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে দুদিনব্যাপী উত্তেজনা, সাংবাদিক, আইনজীবীদের ওপর হামলা, হট্টগোলের মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। গত বুধবার এই ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগেও গতকাল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেন। গত বুধবার হট্টগোল ও ধাক্কাধাক্কির কারণে নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টার পর ভোটগ্রহণ শুরু হয়।

গতকাল দুপুর ১২টার দিকেও দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এবারের নির্বাচনে আট হাজার ৬০২ জন ভোটারের মধ্যে দুদিন চার হাজার ১৩৭ ভোট পড়েছে। নির্বাচন পরিচালনাকে ঘিরে পুলিশের হামলাসহ গেল দিনের ঘটনার বর্ণনা সর্বোচ্চ আদালতে তুলে ধরার মধ্য দিয়েই বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা গতকাল বৃহস্পতিবার তৎপরতা শুরু করেন। 

এরপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মিছিল-স্লোগান, প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে প্রথমে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ও পরে অ্যাটর্নি জেনারেলের সাক্ষাত, ভোটের প্যান্ডেলের সামনে দু’পক্ষের ধাক্কাধাক্কি, পৃথক মামলায় বিএনপিপন্থি ২২ আইনজীবীর আগাম জামিন ও বিকেলে দুপক্ষের ধাক্কাধাক্কির মধ্য দিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের অংশগ্রহণ ছাড়াই সমিতির দ্বিতীয় দিনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে।

দিনভরই ছিল উত্তেজনা। সমিতি ভবন ও প্রাঙ্গণসহ ভোটারদের প্রবেশের জন্য গড়া ভোটের প্যান্ডেলের সামনে ছিল বিপুলসংখ্যক পুলিশ। বিগত বছরগুলোতে নির্বাচনের সময়ে ভোটের প্যান্ডেলের সামনে দুপক্ষের প্রার্থী উপস্থিত থাকতেন। প্রার্থীরা ব্যালট নম্বর উল্লিখিত তাদের পরিচিতির কার্ড ভোটারদের হাতে তুলে দিতেন। তবে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের আইনজীবীদের পক্ষে ভোটারদের হাতে কার্ড তুলে দিতে দেখা গেলেও বিএনপি সমর্থিত প্যানেল থেকে মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে এ সংক্রান্ত কার্ড তুলে দিতে দেখা যায়নি। বেশ কয়েকজন আইনজীবীর ভাষ্যমতে, সমিতির এবাবের ভোটকে ঘিরে উৎসবের আমেজ ছিল না, ছিল এক ধরনের উত্তেজনা।

গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান মনির গণমাধ্যমকে বলেন, সকাল ১০টার পর থেকে শুরু করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট চলে। এবারের নির্বাচনে আট হাজার ৬০২ জন ভোটারের মধ্যে দুদিন চার হাজার ১৩৭ ভোট পড়েছে। মূলত নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটি গঠনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থান নেন। গত সোমবার এই উপকমিটির আহ্বায়ক মনসুরুল হক চৌধুরী পদত্যাগ করলে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে দুই পক্ষ মিলেই মনসুরুল হক চৌধুরী আহ্বায়ক করার বিষয়ে একমত হয়েছিল।

প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই —অ্যাটর্নি জেনারেল : অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি বেসরকারি সংগঠন। এখানে প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির সঙ্গে দেখা করার পর বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১টার দিকে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, প্রধান বিচারপতি ডেকেছিলেন, উনার কক্ষে গিয়েছিলাম। তখন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা বসেছিলেন।

তারা আমাকে জানান, বিএনপি থেকে সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক প্রার্থী কথা বলতে গিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, এটি সমিতির বিষয়, আমাদের করণীয় নেই। প্রধান বিচারপতির এখানে কিছু করার নেই। এটি আপনারা যারা এ বিষয়ে বিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সবাই মিলে পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার চেষ্টা করেন। যেহেতু এটি প্রাইভেট সংগঠন, সমিতির বিষয়। প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই।

আপিল বিভাগে বিএনপিপন্থিরা : গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের আপিল বিভাগে ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা দুজন ১১টার সময় খাস কামরায় আসেন। প্রয়োজন হলে অ্যাটর্নি জেনারেলকে ডেকে নেবো।’ সকাল ৯টার আগে থেকেই আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির এজলাসে (১ নম্বার বিচারকক্ষে) আসতে শুরু করেন বিএনপিপন্থি তিন আইনজীবী। সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতি ও অপর সাত বিচারপতি। এরপর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণে নজিরবিহীন ঘটনা গতকাল ঘটেছে, যা চলমান।

আজও রুমে তালা লাগানো আছে, অনেকের রুমের চারপাশে পুলিশ দেয়া হয়েছে। বাইরে থেকে এ ঘটনার পেছনে কেউ আছে কি-না তা দেখতে হবে। এই অঙ্গনে এটি কি অনুমোদিত? তারা সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্যদেরও নির্যাতন করেছে। আমরা সুরক্ষা চাচ্ছি।’ সভাপতি পদে একটি, সহসভাপতি দুটি, সম্পাদক একটি, কোষাধ্যক্ষ একটি, সহসম্পাদক দুটি, সদস্য সাতটি পদসহ মোট ১৪টি পদে এক বছর মেয়াদের জন্য সমিতির নির্বাচন হয়ে থাকে। বর্তমানে সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ সাতটি পদে আছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা।

অপর সাতটি পদে আছেন বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা। সমিতির নির্বাচনে বিএনপি প্যানেল থেকে সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘আপনারা দেশের বিচার বিভাগের অভিভাবক। তাই প্রত্যেকের ব্যথা, কষ্ট অভিভাবক হিসেবে অবহিত করা উচিত। সমিতির নির্বাচন হয় সব সময় উৎসবমুখর। তবে এবার কি হলো? আজও আমি রুমে ঢুকতে পারিনি। রুমের বাইরে থেকে তালা লাগানো। কক্ষের সামনে পুলিশ রয়েছে। হাজার হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অনেক আইনজীবীরা আহত হয়েছে। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।

গতকালের ঘটনা দেখেছেন, পুলিশ কীভাবে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দিয়েছে। আমরা কী অপরাধ করেছি? আমি প্রার্থী আমি কেন ভোটকেন্দ্রে থাকতে পারব না?’ সমিতির সভাপতি পদপ্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘নজিরবিহীন ঘটনা। ভোটকেন্দ্রে তিন-চারশ পুলিশ ঢুকে ধাক্কা দিতে থাকে। সবাই পড়ে যাচ্ছিল আর পুলিশ পা দিয়ে পাড়িয়েছে। আমার পায়ে ব্যথা আমি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছি না। অনেক আইনজীবী ও সাংবাদিককে আহত করা হয়েছে।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘এ কথাগুলো ভেতরে বসে শুনি। ১১টায় আসেন, আমরা আপনাদের কথা শুনব। এখন কোর্টের কাজ করি।’

সুপ্রিম কোর্টের ঘটনায় আইনজীবী রিমান্ডে : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে মারধর, ভাঙচুর ও চুরির ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় করা মামলায় সালাউদ্দিন রিগ্যানের নামের আইনজীবীর এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর হাকিম মাহবুব আহমেদের আদালত শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ দিন রিগ্যানকে আদালতে হাজির করা হয়। ওই সময় তার সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এসআই জুলহাস উদ্দিন।

অন্যদিকে আসামিপক্ষ রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাকে জামিন না দিয়ে রিমান্ড দেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ব্যালট পেপার ছিনতাই, হট্টগোলের ঘটনায় বিএনপিপন্থি প্যানেলের সভাপতি, সম্পাদক প্রার্থীসহ ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে শাহবাগ থানায় মামলা হয়। এর আগে ১৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রশাসনিক কর্মকর্তা রবিউল হাসান এ মামলা করেন।