তিন কন্যার সংসার। সকাল ৬টায় উঠতে হয় ঘুম থেকে, সন্তানদের জন্য রান্না করে সকাল ৭টার মধ্যেই বের হতে হয় পারুলের। একটু দেরি হয়ে গেলে জ্যামে পড়তে হয়, আর এমন করে তিন দিন দেরি হলেই বেতন কাটা একদিনের। তিন সন্তানের মধ্যে কুলছুম সবার ছোট, বয়স পাঁচ মাস। তাকে নিয়েই যত চিন্তা। বাবা আব্দুস ছালাম পেশায় রিকশাচালক। সংসারে স্বামী আর তিন কন্যা ছাড়া কেউই নেই। আব্দুস ছালাম একটু অলস প্রকৃতির। একদিন রিকশা চালালে দুদিন থাকে বসে। আর তা নিয়ে পারুলের সংসারে অশান্তি নিত্যদিনের সঙ্গী। কোলের শিশুটিকে নিয়েই যেতে হয় কর্মক্ষেত্রে। সেখানে একটা কক্ষে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করে আর মাঝেমধ্যে এসে সন্তানের তৃষ্ণা নিবারণ করেন মা। আর বাকি সন্তানরা বাসায় কি অবস্থায় থাকে তা নিয়ে থাকে এক অজানা দুশ্চিন্তা। এভাবেই নিজের সন্তানদের নিয়ে কষ্টের কথা বলছিলেন মিরপুরের বেবিলনের গার্মেন্টকর্মী পারুল।
ভোর ৬টা। ঘড়ির কাঁটা কিড়িং কিড়িং। অসম্পূর্ণ ঘুম নিয়েই জেগে ওঠার চেষ্টা। চোখ কচলাতে কচলাতে ওয়াশরুমে প্রবেশ। রাতে ভিজিয়ে রাখা কাপড়গুলো পরিষ্কারের চেষ্টা। তার মধ্যে আবার চুলায় ভাত বসানো। কাপড় পরিষ্কার করা, গোসল করা ও ভাত রান্না দেড় ঘণ্টার মধ্যে শেষ। এবার আধা ঘণ্টার মধ্যে কাজে যোগ দেয়ার তাড়া। কারণ ৮টার মধ্যেই শুরু করতে হবে কাজ। দেরি হলে অনুপস্থিতি আবার কোনো কোনো সময় জরিমানা গোনার তাড়া। তখন রাত ১০টা পর্যন্ত খেটেও পুরো দিনের বেতন থেকে বঞ্চিত হতে হবে। কথাগুলো একদমে বলছিলেন পোশাকশ্রমিক রাবেয়া ও জরিনা। মিরপুরের একটি স্বনামধন্য গার্মেন্টে কাজ করেন তারা দুই বোন।
গ্রামের বাড়ি ভালুকায়। প্রায় সাত বছর হয় তারা ঢাকায় এসেছেন। কেমন যাচ্ছে জীবন? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে বড় বোন রাবেয়া দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘জীবন আজ থেমে যাচ্ছে। আমার বাড়িতে মা, তিন ভাই ও এক ছোট বোন আছে। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। অর্থের টানাপড়েনে সাত বছর আগে ঢাকায় আসি। কাজ নিই একটি পোশাক কারখানায়। তখন থেকেই কারখানায় খেটেই যাচ্ছি। জমাতে কিছুই পারিনি। উল্টো এখন সপ্তাহে একদিন যে আমিষ (মাছ-মাংস) জুটত কপালে সেটিও খাওয়া বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। কারণ যে বেতন পাই তাতে ঊর্ধ্বগতির দ্রব্যমূল্যের বাজারে সংসার চলে না। বেতন বাড়ছে না। অথচ বাড়ছে বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল। এছাড়া প্রতিমাসে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতাম বৃদ্ধ মা ও ছোট ভাইবোনদের জন্য। এখন তাও পারছি না।
রাবেয়ার দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছোট মেয়েকে নিয়ে যেতে হয় তার সাথে। সারাদিন মেয়েকে রাখতে হয় অন্য শিশুদের সাথে। কান্না করলেও নির্দিষ্ট সময় ছাড়া সন্তানদের কাছেও আসতে পারেন না। সকাল ৮টা থেকে রাত ৯-১০টা পর্যন্ত চলে যায় কারখানায়। বাসায় এসে গোসল ও খাওয়া শেষে ঘুমাতে বেজে যায় রাত ১টা। রাত দেড়টার দিকে ঘুম আসে। আবার ৬টা না বাজতে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। রোজ মাত্র সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পাই। এতো অল্প সময় ঘুমানোর কারণে শরীরে সারাক্ষণ ঘুম থেকে যায়। কম ঘুমের কারণে দুই বোনই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ডাক্তার দেখাবো, ওষুধ খাব, সেই টাকাও নেই। সারাদিন খেটে যদি পেটে দু’মুঠো ভাত, গায়ে একটি কাপড়, সুস্থ থাকার একটু ওষুধ না জোটে, তবে বেঁচে থেকে কি লাভ? এর চেয়ে আমাদের মতো গরিব মানুষকে আল্লাহ উঠিয়ে নিক। আর যাদের টাকা আছে, সেই মালিকদের আরও টাকা দিক। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও আমাদের শ্রমের-জীবনের মূল্য যেন কমতির দিকে। বেতন বাড়ানো দরকার মনে করছেন না কেউ। কথাগুলো বলছিল ছোটবোন জরিনা।
মায়ের সাথে গার্মেন্টের শিশু কেয়ারে এসেছে পরী। পরীর মতো এই শিশুটি ক্যামেরার সামনে এসে বলছিল— ‘আমাগো ছবি তুলবেন। মায় আয় নাই, ক্ষিধা লাগছে।’ এভাবেই এই শিশু কেয়ারে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাকে ছাড়া থাকতে হয় শতশিশুকে। এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম সমাজবিজ্ঞানী আনোয়ার হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, ‘শিশুরা দীর্ঘদিন এভাবে পরিবার ছাড়া বড় হলে তাদের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া মা-বাবা দূরে থাকার কারণে এই শিশুদের মানসিক সমস্যাও হতে পারে। শিশুদের পরিবারের সদস্যদের সাথে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। এতে শিশুর মেধার বিকাশ ঘটে অন্যথায় শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
মিরপুরের একটি গার্মেন্টের জেনারেল ম্যানেজার আব্দুস ছাত্তার। তিনি বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানে চার থেকে পাঁচশতাধিক গার্মেন্টকর্মী থাকে। তাদের অনেকেরই শিশু সন্তান আছে। আমরা তাদের কথা চিন্তা করে শিশু কেয়ার হাউস করে থাকি। অনেক প্রতিষ্ঠানে নেই। কিন্তু সব গার্মেন্টে থাকা উচিত। দীর্ঘদিন যাবৎ নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন অধ্যাপক রেহানা মাহবুব। তিনি বলেন, এভাবে রাত দিন কাজ করলে নারীরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাছাড়া এরা মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। আমাদের নারীরা যত পরিশ্রম করে সেই অনুযায়ী তাদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। এই ক্ষেত্রে নারীরা এখনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই শিশুরা যদি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে না পারে তাহলে এই সমাজ এগোবে কি করে। এই শিশুদের আগামী হোক সুন্দর ও বর্ণিল এমনটাই প্রত্যাশা বিশ্লেষকদের।