সড়ক, যানবাহন ও দক্ষ চালক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলার তিন মূল নিয়ামক। যদিও দেশে এর কোনোটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। ফলে নিয়ন্ত্রণেই আসছে না সড়ক দুর্ঘটনা। আবার আইনের প্রয়োগের মাধ্যমেও এ খাতকে সুশৃঙ্খল রাখার ব্যবস্থা কার্যকর নয়। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা রাজনৈতিক প্রভাব। যে কারণে বিশৃঙ্খলার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে পরিবহন খাত। জনপ্রত্যাশা মেনে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে প্রাণহানি কমানো ছাড়া সরকারের সামনেও নেই কোনো বিকল্প। এসব নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও উপেক্ষিত হচ্ছে বছরের পর বছর।
২০১৮ সালে ২৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে ঈদযাত্রায় প্রাণহানির প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী নিজেই দিয়েছিলেন পাঁচটি নির্দেশনা— ১. দূরপাল্লার পথে বিকল্প চালক রাখা। যাতে একজন চালককে টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি চালাতে না হয়; ২. নির্দিষ্ট দূরত্বে সার্ভিস সেন্টার বা চালকদের জন্য বিশ্রামাগার করা; ৩. গাড়ির চালক ও তার সহকারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া; ৪. সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করা বা অবৈধভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা; ৫. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এসব নির্দেশনার একটিও আদৌ বাস্তবায়ন হয়নি। যার দরুন সড়ক-মহাসড়কে একের পর এক ঘটেই চলেছে দুর্ঘটনা।
গতকাল মাদারীপুরের ঘটনাও তারই বহিঃপ্রকাশ। যে ঘটনায় ঘটল সাম্প্রতিকালের সর্বোচ্চ প্রাণহানি। এ ছাড়া গত শুক্রবারও পিরোজপুরে পাঁচজনসহ এক দিনেই সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১১ জনের প্রাণহানি ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনায় এসব প্রাণহানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন খাতে এ মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণহানি কমানো। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে দুর্ঘটনা বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে চালকের বিরতিহীন ড্রাইভিংয়ের পাশাপাশি মহাসড়কে মিশ্র-পরিবহন চলাচল, সড়কের গতি ব্যবস্থাপনা না থাকা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, মহাসড়কের পাশে হাটবাজার ও সড়ক নির্মাণসংক্রান্ত ত্রুটিও দায়ী।
তবে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে চালকের বিশ্রাম না থাকা এবং অমনোযোগী হওয়াকেই দায়ী করছেন সবাই। সমপ্রতি রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘুরে এবং চালক-হেলপারদের সাথেও কথা বলে জানা গেছে, দূরপাল্লার অধিকাংশ বাসের চালকই দৈনিক ২০ ঘণ্টারও বেশি সময় কাজে নিয়োজিত থাকেন।
বিশ্রামহীন ড্রাইভিংয়েই সড়ক-মহাসড়কে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে গাড়ি চালানোর জন্য অধিকাংশ সময় স্নায়বিক সমস্যায় ভোগেন দূরপাল্লার বাস-কোচের চালকরা। ফলে চালকের আসনে বসে তারা অমনোযোগী হয়ে পড়েন। এতে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা। এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে দূরপাল্লার বাসগুলোতে দুজন করে চালক রাখার যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই নির্দেশনাও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। জানা গেছে, ঢাকা থেকে দেশের জেলা শহরগুলোতে যাত্রী পৌঁছানোর পর পরবর্তী ট্রিপের জন্য আবারও তাদের ফিরতে হয় ঢাকায়।
এ ক্ষেত্রে তারা মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছেন। অনেকের ক্ষেত্রে সে সুযোগও পাচ্ছেন না। ঢাকায় ফিরে ফের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করছেন। সায়েদাবাদে জুয়েল নামে এক চালক গতকাল আমার সংবাদকে জানান, সায়েদাবাদ থেকে যেসব বাস দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যায় তাতে একজন চালকই রয়েছে। দু’জন চালক কোনো বাসেই যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, মালিকপক্ষই দুজন চালক রাখতে চান না। এ কারণেই দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন।
গতকাল ভোরে ঢাকার উদ্দেশে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের বাসটিতেও চালক ছিলেন একজন। ওই চালক ভোর সোয়া ৫টায় খুলনা থেকে ১৬ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। বাকি সব যাত্রী ওঠেন গোপালগঞ্জ থেকে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন আমার সংবাদকে বলেন, দুটি কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যাচ্ছে। একটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, অন্যটি টায়ার ব্রাস্টে। তবে তিনি আরও একটি কারণ উল্লেখ করেছেন। সেটি চালকের বিশ্রাম অর্থাৎ ভোর সোয়া ৫টায় রওনা দেয়া ওই চালক রাতেই ঢাকা ফিরেছিলেন কি-না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যে পরিমাণ ঘুম কিংবা বিশ্রামের পর গাড়ি চালানোর কথা তা হয়তো হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীসহ একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, ওই গাড়ির টায়ারও মহাসড়কে চলাচলের অনুপোযোগী ছিল। গেটিস দেয়া টায়ার নিয়ে চলাচল করছিল গাড়িটি। যে কারণে টায়ার ব্রাস্টের ঘটনাও সঠিক হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি। আবার গতি বেশি থাকায় সড়ক বিভাজনের ওপর ওঠে যায় এবং রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায় গাড়িটি। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, চার বছর আগেও (২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর) একই রুটের গোপালগঞ্জে দুর্ঘটনায় পড়েছিল ইমাদ পরিবহনের বাস। সেই দুর্ঘটনায় মারা যায় চারজন। এরপর থেকে বাসটির চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল।
এখন সেই বাসটির নিবন্ধন বাতিল ও মালিক গোপালগঞ্জের হাবিবুর ররহমান শেখের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠছে, ২০১৯ সালের পর চার বছর ধরে কীভাবে সড়কে চলাচল করল রুট পারমিট হারানো সেই বাসটি। এ বিষয়ে বিআরটিএর অপর একটি সূত্র বলছে, স্থগিতের পর পুনরায় চলছে কি-না এটি জানতে বিআরটিএর লোকবলের ঘাটতি রয়েছে। তবে পুলিশ চাইলেই ব্যবস্থা নিতে পারত। পুলিশের নীরবতায় মূলত এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিআরটিএর হিসাবে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোট মোটরযানের সংখ্যা সাড়ে ৫৬ লাখের কিছু বেশি। মোটরযান চালকের লাইসেন্স আছে ৫০ লাখের কম। অর্থাৎ নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যার চেয়েও লাইসেন্স কম। যদিও যত লাইসেন্স, তত চালক নেই। কারণ, একজন ব্যক্তির একাধিক ধরনের লাইসেন্স থাকতে পারে। যেমন কেউ মোটরসাইকেল এবং হালকা যানবাহনের লাইসেন্স নিলে দুটি লাইসেন্স হিসেবে গণ্য হবে। এ বিবেচনায় দেশে যানবাহনের চেয়ে চালকের সংখ্যা অনেক কম। বিআরটিএর হিসাবে, লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ৪০ লাখের মতো। অথচ বিআরটিএর পূর্বাভাস হচ্ছে— বর্তমানের হারে নিবন্ধন চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ যানবাহনের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
এ সময় চালকের প্রয়োজন পড়বে প্রায় দেড় কোটি। কারণ, একটি দূরপাল্লার কিংবা বাণিজ্যিক যানবাহনে একাধিক চালক দরকার। এ পরিস্থিতিতে সড়কে প্রাণহানি বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসাবে, ২০১৫-১৬ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয় দুই হাজার ৪৬০ জনের। এরপর প্রতি বছরই বেড়েছে। এর মধ্যে তিন বছর ধরে প্রাণহানির সংখ্যা চার হাজারের ওপরে উঠেছে। বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর সড়কে প্রাণ গেছে সাত হাজার ৭১৩ জনের।