পবিত্র রমজান মাস জীবন পরিবর্তনের সুবর্ণ সুযোগ। নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে রমজানের শিষ্টাচারগুলো যথাযথভাবে পালন করা প্রয়োজন। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় তা দারুণ সহায়ক হয় এবং রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি কাটিয়ে পরিপূর্ণ ফজিলত ও সওয়াব লাভের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। রোজা রাখার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে তার মনোনীত ধর্ম ইসলামে পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে হবে। প্রবৃত্তির অনুসরণ ও শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা, সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা বাকারা-২০৮)
লৌকিকতা বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। অন্য যেকোনো ইবাদতের মতো রোজাও ইখলাস ছাড়া আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। অন্যদিকে ইবাদত যতই ইখলাসপূর্ণ হোক না কেন, তা যদি মহানবী সা.-এর সুন্নত অনুসারে না হয়, তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
তিনি যেভাবে রোজা রেখেছেন, সাহরি ও ইফতার করেছেন, আমাদেরও সেভাবে তা সম্পাদন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে প্রিয় নবী সা.-এর অনুসরণের বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘হে রাসূল, আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ করো; তা হলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল দয়ালু’ (সূরা আলে ইমরান-৩১)। রোজাদারকে খেয়াল রাখতে হবে, সাহরি-ইফতারসহ সব আমল যেন রাসূল সা.—এর অনুসরণে হয়। অধিক পানাহারের মাধ্যমে যেন রোজার মহিমা ক্ষুণ্ন না হয়।
রোজাদারকে এমন সব কাজ পরিহার করতে হবে, যা রোজা নষ্ট করে। তাই রোজা রেখে অযথা কথাবার্তা ও ঝগড়া-বিবাদে জড়ানো যাবে না। মহানবী সা. বলেন, ‘শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই রোজা নয়। বরং রোজা হলো অনর্থক-অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। যদি তোমার সঙ্গে কেউ ঝগড়া-বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায় অথবা মুর্খ আচরণ করে, তবে তাকে বলে দেবে আমি রোজাদার’ (মুসতাদরাকে হাকিম : ১৫২০)।
রোজা রেখে মিথ্যা, গিবত, কড়া কথা, ঝগড়া-বিবাদসহ যাবতীয় মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা জরুরি। রোজা অবস্থায় গিবত থেকে বেঁচে থাকতে হবে। রমজান মাসে রোজা অবস্থায় কেউ গিবত বা মিথ্যাচার করলে তার ভয়াবহতা সাধারণ যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। মিথ্যাচার ও গিবতের কারণে রোজা ভেঙে যায় না ঠিক, তবে রোজার সওয়াব ও গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘রোজা হলো (জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার ঢাল), যে পর্যন্ত না তাকে বিদীর্ণ করা হয়। জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, কিভাবে রোজা বিদীর্ণ হয়ে যায়? নবী করিম সা. বললেন, ‘মিথ্যা বলার দ্বারা অথবা পরনিন্দা করার দ্বারা।’ (নাসায়ি-২২৩৫) রোজা রাখার মাধ্যমে অসহায়, সম্বলহীন ও অভুক্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
তাই এ দান-প্রতিদানের পবিত্র মাসে তাদের জন্য বেশি করে কল্যাণকর কাজ করা উচিত। ইফতার করানো, সদকাতুল ফিতর, জাকাত আদায় করা ছাড়াও ব্যাপকভাবে দান-সদকা করা যেতে পারে। হাদিসে এসেছে, ‘মহানবী (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তাঁর দানশীলতা আরও বেড়ে যেত’ (মুসলিম : ৩২০৮)।
রোজায় নিজের খাবারের চিন্তা না করে গরিবদের খাবারেরও চিন্তা করা দরকার। এতে অর্জিত হয় অনেক পুণ্য। জায়েদ ইবনে খালেদ জুহানি (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে; রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না’ (তিরমিজি : ৮০৭; ইবনে মাজা : ১৭৪৬)। খাবার খাওয়ানোর ইবাদতের মাধ্যমে আরও অনেক ইবাদত পালিত হয়। যেমন-নিমন্ত্রিত ভাইদের সঙ্গে হূদ্যতা ও ভালোবাসা।
যে হূদ্যতা ও ভালোবাসা জান্নাতে প্রবেশের কারণ। যেমনটি নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ঈমান আনা ছাড়া জান্নাত যেতে পারবে না। আর পারস্পরিক ভালোবাসা ছাড়া তোমরা মুমিন হতে পারবে না।’ (মুসলিম : ৫৪)
রোজা ত্যাগের মাস, সংযমের মাস। এ মাসে খাওয়া-দাওয়া, ঘুমসহ যাবতীয় জৈবিক চাহিদা কমিয়ে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতে বলা হয়েছে। তাই দিনের বেলা রোজা রেখে রাতের বেলায় অধিক পরিমাণে পানাহার করা শিষ্টাচার পরিপন্থি।
সেহরি ও ইফতারে বিলাসী আয়োজন ইসলাম নিরুৎসাহিত করে। বিশেষ করে সেহরি ও ইফতারে অপচয় করা মোটেও অনুমোদিত নয়। তা ছাড়া সারা দিন ঘুমিয়ে অলস সময় যাপন করাও ঠিক নয়। বরং আয়-রোজগার ও স্বাভাবিক কাজকর্ম এবং ইবাদত অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ খাবার-দাবার, সময়, শক্তি কোনো কিছুই অপচয় করা ইসলাম অনুমোদন করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই আর শয়তান তার পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)। আল্লাহ সবাইকে বোঝার ও আমল করার তওফিক দিন।