যে নির্দেশনাবলি দেয়া হয়েছে সেগুলো মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চলছে
—মুনিবুর রহমান
অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক), ডিএমপি
অপরিকল্পিত পার্কিং, রাস্তার সংকটসহ একাধিক কারণে মুক্তি মিলছে না
—হানিফ খোকন
সভাপতি, সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ
যানজট ঢাকার নিত্যসঙ্গী। তবে রমজান এলেই এর ভোগান্তি পৌঁছায় অসহনীয় পর্যায়ে। প্রত্যেক বছর রমজান এলেই পাল্টে যায় সড়কের চিত্র। সংকুচিত হয়ে যায় ফুটপাতসহ মূল সড়কও। সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। বিশেষ করে অফিস ছুটি শেষে ইফতারের আগ পর্যন্ত সময়ে রাজপথে তৈরি হয় ভয়াবহ অবস্থা। প্রধান সড়ক গড়িয়ে যানজটের প্রভাব পড়ে অলিগলি, উপসড়কেও। এবারের রমজানেও ঢাকার সড়কগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে একই অবস্থা। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে সময়ের ব্যবধান তৈরি হচ্ছে রমজানের আগের সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কোথাও কোথাও আধ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে লাগছে দুই ঘণ্টা। যদিও এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবার ১৫ দফা নির্দেশনা দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি। এরপরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি মোটেও; বরং যতই ঘনিয়ে আসছে ঈদ, ততই প্রকট হচ্ছে যানজট পরিস্থিতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিকল্পিত পার্কিং, কোথাও সড়কের ৪০ কোথাও ৫০ শতাংশ হকারদের দখল, দোকানের সামগ্রী রাস্তায় রাখা, অননুমোদিত ৫০ লাখ মোটরসাইকেলের বেপরোয়া চলাচল, সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন দেয়া রিকশা, ফুটপাত রেখে শোরুমের গাড়ি বিক্রির ব্যবসায় সড়ক সংকুচিত হয়ে আসায় যানজটের তীব্রতা থেকে মুক্তি মিলছে না। রমজানে এর তীব্রতা আরও কয়েকগুণ বেশি বৃদ্ধি পায়।
যানজটের অন্যতম আরও একটি কারণ হিসেবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন শহরের মূল আয়তনের তুলনায় রাস্তার সংকটের কথা উল্লেখ করেন। আমার সংবাদকে তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য মেগাসিটির মূল আয়তনের ২৫ শতাংশ যেখানে রাস্তা, সেখানে আমাদের দেশে মাত্র ৭ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের নিবন্ধতি যানবাহনের বাইরেও চলছে কয়েকগুণ বেশি অনিবন্ধিত যানবাহন। ঢাকায় যেমন ১০ লাখ বাণিজ্যিক মোটরসাইকেলের বিপরীতে সড়ক দখল করছে অন্তত ৫০ লাখ মোটরসাইকেল। এটি যানজটের অন্যতম কারণ। এদের অধিকাংশই মানছে না ট্রাফিক আইন। ঢাকার ফুটপাতও অনেকটাই এদের দখলে। এ ছাড়া রিকশার কারণেও যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে ঢাকায়। যেখানে সিটি কর্পোরেশনই নিবন্ধন দিচ্ছে এসব রিকশার। এদিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইফতার সামগ্রী বিক্রি, টার্মিনালের বাইরে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূরপাল্লার পরিবহনে যাত্রী উঠানো, রাস্তায় আড়াআড়ি করে দাঁড়িয়ে লোকাল পরিবহনের যাত্রী উঠানামা করানো, সেবা সংস্থাগুলোর খোঁড়াখুঁড়ির কাজেই যানজট ভোগান্তি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। যা থেকে নগর পুলিশের দেয়া ১৫ দফা নির্দেশনাতেও মুক্তি মিলছে না।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের একাধিক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, রমজানে রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি মোকাবিলাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ডিএমপি কমিশনার সব ডিসি-এডিসিদের সঙ্গে দুদিন বৈঠক করেছেন। আরো বৈঠক হবে। মতিঝিল, পল্টন, গুলিস্তান, উত্তরা, বনানী, গুলশানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হবে। তাদের সঙ্গে থাকবে কমিউনিটি ট্রাফিক পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে কুইক রেন্সপন্স টিম প্রয়োজনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকবে। এই টিমের সদস্যরা রাস্তায় বিশেষ পরিস্থিতিতে কাজ করবে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে রাস্তায় ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়ে যায়। তখন প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরই মধ্যে গতকাল ঢাকার সায়েদাবাদে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চট্টগ্রামমুখী সড়কে রাস্তায় বাস দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া টার্মিনাল থেকে বাস বের হয়ে সড়কে থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হচ্ছে।
সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশকে গাড়ি সরাতে দেখা যায়নি। তবে জনপথের মোড়ে টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে যাত্রী নিতে পুলিশ বাধা দিলেও কিছু দূর গিয়ে আবারও সেই একই কাজ করতে দেখা গেছে চালকদের। দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা বলছেন, পুলিশ সামনে পড়লে গাড়ি চলমান রাখে, আড়ালে গেলে একই ঘটনা ঘটায়। মহানগরের ভেতরেও যেখানে-সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করা হচ্ছে। ক্রসিংগুলোতে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সামনেই অনেক স্থানে যাত্রী ওঠানামা করতে দেখা গেছে। তখন চালকরা কৌশলে বাসের গতি কমিয়ে দেন। ফলে ক্রসিংগুলোতে যানজট আরও বেড়ে যায়। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকারই।
অথচ যানজট নিয়ন্ত্রণে বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে রমজানের শুরু থেকেই ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এবার রমজানে ‘সহনীয় যানজট’ উপহার দেয়ার জন্য সড়ক ও ফুটপাত দখল করে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, ইফতারসামগ্রী বেচাকেনা করতে দেয়া হবে না। রাস্তা দখল করে কোনো হকার বা ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা থাকবে না। এ জন্য রাজধানীতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। সেবা সংস্থাগুলোকে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ বন্ধ রাখা ও চলমান কাজগুলো দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেয়া হয়। রুট পারমিটবিহীন কোনো যানবাহন যাতে চলতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চলবে।
সড়কের মোমেন্টাম (গতিবেগ) স্বাভাবিক রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে মোতায়েন থাকবে অতিরিক্ত ফোর্স। ট্রাফিক বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা মাঠে থাকবেন এসব কার্যক্রম তদারকির জন্য। যদিও বরাবরের মতো ফুটপাত-সড়ক দখল করে দেদার চলছে ইফতারসামগ্রীর বেচাবিক্রি। পাশাপাশি বসছে দোকানপাটও; বরং ফুটপাত-রাস্তার ব্যবসা যেন আরও জমে উঠেছে ঈদ সামনে রেখে। খোঁড়াখুঁড়ির কাজও বন্ধ হয়নি। সেবা সংস্থাগুলো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমই বহাল রেখেছে। ফলে ‘সহনীয় যানজটে’র দেখা রমজানে মেলেনি। তবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলছেন, যানজট নিরসনে যে নির্দেশনাবলি দেয়া হয়েছে, সেগুলো মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চলছে।