পবিত্র মাহে রমজানে পরিবারের জন্য বিপুল অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ইফতার-সাহরিসহ প্রয়োজনীয় কেনাকাটার পাশাপাশি অনেকে দান-সদকা ও জাকাত বিতরণ করেন এ মাসে। তাই পরিবার-পরিজনের বাড়তি ব্যয়ের কথা মাথায় রেখে বরকতের এ মাসে বেশি বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন তারা। ফলে গত কয়েক মাস ধরে চলমান প্রবাসী আয়ের খরা কাটিয়ে সদ্যসমাপ্ত মার্চ মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দুই বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। যা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গতকাল রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্চে ২০১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় (প্র?তি ডলার ১০৭ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ২১ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর আগে সর্বশেষ দুই বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল গত বছরের আগস্টে। ওই মাসে আসে ২০৩ কোটি (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার। মার্চে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ আগের মাস ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৪৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার বেশি।
ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলার। এছাড়া আগের বছরের (২০২২ সালের) মার্চের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ বা ১৫ কো?টি ৮০ লাখ ডলার। গত বছরের মার্চে প্রবাসী আয় ছিল ১৮৫ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। রমজান উপলক্ষে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেলেও তা আশানুরূপ নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ মার্চে আসা রেমিট্যান্স চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের চেয়েও কিছুটা কম। অথচ গত ৯ মাসে বিপুল কর্মী বিদেশে গেছেন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, গত জুনে বিপুল জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল। ওই মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ১১ হাজার ৫৩৯ জন। যা আগের মাসের তুলনায় ৪৪ শতাংশ বেশি। ফলশ্রুতিতে চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম মাস জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। এটি আগের মাস জুনের তুলনায় প্রায় ২৬ কোটি ডলার বেশি। এরপর জনশক্তি রপ্তানির ধারা অব্যাহত থাকলেও প্রবাসী আয়ে ধস নামে। অবৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স চলে যাওয়ায় জনশক্তি রপ্তানির সাথে তাল মিলিয়ে দেশে প্রবাসী আয় আসছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছর (২০২২ সালে) ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছেন। গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী সাড়ে আট মাসে (জুলাই-মার্চ) বিদেশে গিয়েছেন এক লাখ চার হাজার ৫১৩ জন কর্মী। করোনার কারণে ২০২১ সালে অনেক কর্মী পাঠানো বন্ধ ছিল। বিপরীতে বিপুল সংখ্যক কর্মী দেশে ফিরে আসে। কিন্তু গতবছর আবার বিদেশে যাওয়া শুরু হয়।
তথ্যমতে, সামপ্রতিক মাসগুলোতে যাওয়া কর্মীদের বড় একটি অংশ গেছে ইউরোপ-আমোরিকায়। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া ও কুয়েতসহ কয়েকটি দেশ যাদের মুদ্রার মান বেশি এমন কয়েকটি দেশেও দীর্ঘদিন পর জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। এসব দেশ থেকে সৌদি আরব, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর তুলনায় বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স আসার কথা। কিন্তু আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত মার্চ মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ২৩ কোটি ৪৬ লাখ মার্কিন ডলার, বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে চার কোটি ৫০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৭৩ কোটি ১৫ লাখ মার্কিন ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৬৫ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স।
রেমিট্যান্স বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ সেবার বিনিময়ে দেশে রেমিট্যান্স আয় আনতে ফরম সি পূরণ করার শর্ত শিথিল করেছে। পাশাপাশি সেবা খাতের উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকদের ঘোষণা ছাড়াই ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
রেমিট্যান্স বাড়াতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বৈধ উপায়ে ওয়েজ আর্নার্স রেমিট্যান্সের বিপরীতে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা, রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননা দেয়া, রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সমপ্রসারণ ও সহজ করার পাশাপাশি অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ন অর্থায়ন সুবিধা দেয়া, ফিনটেক পদ্ধতির আওতায় আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অপারেটরকে বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে ড্রয়িং ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা এবং রেমিট্যান্স পাঠাতে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর চার্জ ফি মওকুফ করা হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম (জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত) ৯ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৬৩০ কোটি মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৫২৯ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে গত বছরের তুলনায় ৭৪ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার।