আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের রব বলেন, আমাকে ডাকো। আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব। যেসব মানুষ গর্বের কারণে আমার দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা অচিরেই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’ (সূরা মুমিন-৬০
দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের রব বলেন, আমাকে ডাকো। আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব। যেসব মানুষ গর্বের কারণে আমার দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা অচিরেই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’ (সূরা মুমিন-৬০) আয়াতটিতে দোয়া ও ইবাদত শব্দ দুটিকে সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
কেননা, প্রথম বাক্যাংশে যে জিনিসকে দোয়া শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে দ্বিতীয় বাক্যাংশে সে জিনিসকেই ইবাদত শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, দোয়াও ঠিক ইবাদত তথা ইবাদতের প্রাণ।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে না এমন লোকদের জন্য ‘অহঙ্কার ও গর্বভরে আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়’ কথাটি প্রয়োগ করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, আল্লাহর কাছে দোয়া করা বন্দেগি বা দাসত্বের দাবি। দোয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গর্ব ও অহঙ্কারে ডুবে আছে। এ কারণে নিজের স্রষ্টা ও মনিবের কাছে দাসত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ দুই হাত তুলে দোয়া করে না।
নবী সা. তার বাণীতে আয়াতের এ দুটি বিষয় পরিষ্কার বর্ণনা করেছেন। নুমান ইবনে বাশির রা. বর্ণনা করেছেন, নবী সা. বলেছেন, ‘দোয়াই ইবাদত’। তারপর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন। (তোমরা আমাকে ডাকো আমি সাড়া দেবো) (আহমাদ, তিরমিজি)
দোয়াতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও বড়ত্বের প্রকাশ ঘটে। সূরা আল ফাতিহায় দোয়ার কৌশল বর্ণিত হয়েছে। সেখানে আপনি লক্ষ্য করুন, প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিচ্ছি, বলছি ‘সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি নিখিল জাহানের রব।
যিনি পরম দয়ালু ও দয়াবান, তিনি বিচার দিবসের মালিক।’ (আয়াত : ১-৩) এর পরের এক আয়াতে নিজের দাসত্ব, দীনতা ও মুখাপেক্ষিতা প্রকাশপূর্বক বলছি, ‘আমরা কেবল তোমারই গোলামি করি এবং কেবল তোমারই কাছে সাহায্য চাই।’ (আয়াত-৪) তার পরের তিন আয়াতে নিজের ঈপ্সিত চাহিদার কথা বলছি, ‘তুমি আমাদের সোজা পথ দেখাও, তাদের পথ যাদের তুমি অনুগ্রহ করেছ, যাদের ওপর গজব পড়েনি এবং পথভ্রষ্ট হয়নি।’ (আয়াত : ৫-৭) উল্লিখিত আয়াতে যে কথাটি বলা হয়েছে তা হলো- দোয়া কবুল হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় তার একটি ছোট বা বড় ফায়দা থাকে, কোনো অবস্থায়ই তা ফায়দাহীন নয়।
সে ফায়েদা হলো, বান্দা তার প্রভুর সামনে নিজের অভাব ও প্রয়োজন পেশ এবং দোয়া করে তার প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয় এবং নিজের দাসত্ব ও অক্ষমতা স্বীকার করে। নিজের দাসত্বের এ স্বীকৃতিই যথাস্থানে একটি ইবাদত তথা ইবাদতের প্রাণসত্তা। বান্দা যে উদ্দেশ্যে দোয়া করল সেই বিশেষ জিনিসটি তাকে দেয়া হোক বা না হোক কোনো অবস্থাই সে তার এ দোয়ার প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে না। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত নবী সা. বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে দোয়ার চাইতে অধিক সম্মানার্হ জিনিস আর কিছুই নেই।’
হজরত ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত নবী সা. বলেছেন, ‘যে বিপদ আপতিত হয়েছে তার ব্যাপারেও দোয়া উপকারী। অতএব হে আল্লাহর বান্দারা, তোমাদের দোয়া করা কর্তব্য।’ (তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ) ‘তোমাদের প্রত্যেকের উচিত তার রবের কাছে নিজের প্রয়োজন প্রার্থনা করা। এমনকি জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলে তাও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে।’
অর্থাৎ মানুষ যে ব্যাপারগুলো নিজের এখতিয়ারভুক্ত বলে মনে করে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের আগে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে। কারণ, কোনো ব্যাপারে আমাদের তদবিরই আল্লাহর তাওফিক ও সাহায্য ছাড়া সাফল্য লাভ করতে পারে না। চেষ্টা-তদবির শুরু করার আগে দোয়া করার অর্থ হচ্ছে, বান্দা সর্বাবস্থায় তার নিজের অক্ষমতা ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করছে।
দোয়ার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা যা অনেক মানুষের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে থাকে; দোয়া করার ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তা হলো, তাকদিরের ভালো-মন্দ যখন আল্লাহর এখতিয়ারে তখন তিনি তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে যে ফায়সালা করেছেন সেটিই অনিবার্যরূপে ঘটবে। সুতরাং আমার দোয়ার সব গুরুত্ব মুছে ফেলে- এ ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে পড়ে থেকে যদি মানুষ দোয়া করেও সে দোয়ার প্রাণ থাকে না। কুরআন মাজিদের এ আয়াতটি এ ভ্রান্ত ধারণা দূর করে।