সংসদে এখন বিতর্ক দেখা যায় না, সৌন্দর্য হারিয়েছে
—ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, প্রথম সংসদের সদস্য
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী এবং স্পিকারও নারী। এটি অনেক গৌরবের —ড. শিরীন শারমিন, স্পিকার
আজ ৭ এপ্রিল শুক্রবার জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। পূর্তি উপলক্ষে গতকাল ‘সংসদে বঙ্গবন্ধু’ ও ‘মুজিববর্ষ বিশেষ অধিবেশন’ শীর্ষক দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়। জাতিরপিতা ছিলেন প্রথম সংসদের সংসদ নেতা। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল ঢাকার তেজগাঁওয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদ ভবনে। সেই হিসাবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ অর্ধশত বছর পূর্ণ করছে। তবে ৫০ বছরে এসেও সংসদীয় রাজনীতির সুফল এখনো অধরা বলেই মনে করা হচ্ছে। ১১টি সংসদে অর্ধেকের বেশি সময় বিরোধী দল ছিল নামকাওয়াস্তে। বাকি সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখনই বিরোধী দলে ছিল তখনই রাজনৈতিক দলগুলো সংসদ বর্জনের পথ বেছে নিয়েছে। এ ছাড়া ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর মতো ত্যাগী রাজনীতির সংখ্যাও কমে গেছে। সম্পদশালী ব্যক্তিরা সংসদে প্রধান্য পেতে শুরু করেন। টিআইবির এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ৫০ বছরে ব্যবসায়ী সংসদ সদস্যের সংখ্যা ১৭ থেকে ৬২ শতাংশ পৌঁছে গেছে।
জানা যায়, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ১৫টি। অর্থাৎ, প্রথম জাতীয় সংসদে সদস্য সংখ্যা ছিল ৩১৫। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় তেজগাঁওয়ে জাতীয় সংসদ ভবনে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। প্রথম জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন মুহম্মদুল্লাহ এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন মো. বয়তুল্লাহ। পরে মুহম্মদুল্লাহ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে আবদুল মালেক উকিল স্পিকার নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গতকাল বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। গতকাল বেলা ১১টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশেষ অধিবেশন বসে।
বিশেষ অধিবেশনটি চলতি একাদশ সংসদের ২২তম এবং চলতি বছরের দ্বিতীয় অধিবেশন। এর আগে গত ৫ জানুয়ারি চলতি বছরের প্রথম তথা ২১তম অধিবেশন শুরু হয়ে শেষ হয় ৯ ফেব্রুয়ারি। ওই অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ২৬টি। যেখানে ১৯টি বিল উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে বিল পাস হয় ১০টি। এ ছাড়া একটি অধ্যাদেশও উত্থাপিত হয়। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ আজ শুক্রবার বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। বিশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের যাত্রা থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত ঐতিহাসিক বিভিন্ন অর্জনসমূহ তুলে ধরা হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণসমূহ প্রচার করা হবে। সংসদ সদস্যরা বিশেষ অধিবেশনে সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আলোচনা করবেন।
১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ যাত্রা শুরু করে উল্লেখ করে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭৩ সালের ওই দিন সংসদের প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে আমরা সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি। এ জন্য ৭ এপ্রিল সংসদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। তিনি বলেন, আমরা যখন সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি তখন একাদশ জাতীয় সংসদ চলমান। এটি অনেক গৌরবের বিষয়। আমাদের সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী ও স্পিকারও একজন নারী। যেটি জাতীয় সংসদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের কার্যক্রম তুলে ধরে স্পিকার বলেন, ৫০ বছরের এই বিশেষ সময়টিকে উদযাপনের জন্য কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। তার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে— একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ইতোমধ্যে এই বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করেছেন। সেখানে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আসবেন, তিনি স্মারক বক্তৃতা দেবেন। পরবর্তী অংশে ১৪৭ বিধিতে সাধারণ আলোচনার জন্য সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাব তুলবেন।
প্রধানমন্ত্রী সেটি উত্থাপন ও বক্তব্য রাখার পর সব সদস্য এই আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। আলোচনায় আমরা প্রবীণ সদস্য বিশেষ করে ১৯৭৩ সালের সংসদের সদস্যদের অভিজ্ঞতা আমরা শুনব। ৮ এপ্রিল আলোচনা শুরু হয়ে ৯ এপ্রিল তা সমাপ্তির দিকে যাবে এবং প্রস্তাব সাধারণ সর্বসন্মতক্রমে গ্রহণ করা হবে। এর মাধ্যমে অধিবেশন সমাপ্তির দিকে যাবে। আমরা বিশেষ অধিবেশনের একটি খসড়া কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। এর সব কিছু চূড়ান্ত হবে কার্যউপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে। স্পিকার জানিয়েছেন, বিশেষ অধিবেশনের আলোচনাগুলো লিপিবদ্ধ করা হবে। তা একত্রিত করে বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হবে। এর আগে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে যে বিশেষ অধিবেশন হয়েছিল তার আলোচনাগুলোকেও বই আকারে ইতোমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। ড. শিরীন শারমিন বলেন, আমরা প্রবীণ সংসদ সদস্যের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পারস্পরিক একটি মতবিনিময়ের চিন্তা করছি। সিনিয়র সংসদ সদস্যরা তাদের অভিজ্ঞতা সেখানে শেয়ার করবেন। বর্তমানের তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন থাকলে সেটি করবেন। আমরা আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনও করতে চাই। সেটি হয়তো বাজেট সেশনের পরে হবে। সেখানে আমরা অন্যান্য দেশের কিছু স্পিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাব। সেটি সুবর্ণজয়ন্তী পালনের অংশ হবে বলে আশা করছি। সেটি সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে হয়তো হবে।
সংসদীয় রাজনীতির সুফল এখনো অধরা : ১১টি সংসদে অর্ধেকের বেশি সময় বিরোধী দল ছিল নামকাওয়াস্তে। বাকি সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখনই বিরোধী দলে ছিল, তখনই তারা সংসদ বর্জনের পথ বেছে নিয়েছে। ফলে জনগণের মনোযোগ হারিয়ে গেছে সংসদের কার্যক্রম থেকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) হিসাবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সংসদে পেশায় সরাসরি ব্যবসায়ী এমন এমপি ছিলেন ১৭ দশমিক শূন্য ৫ ভাগ। বর্তমান সংসদে পেশাদার ব্যবসায়ী এমপি হলেন ৬১ দশমিক ৭৩ ভাগ। এ নিয়ে জানতে চাইলে প্রথম সংসদের সদস্য ও প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, বর্তমানে সংসদীয় রাজনীতির সুফল থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সংসদের যে গুরুত্ব ছিল প্রাণ ছিল তা ধীরে ধীরে কিছুটা কমেছে। সংসদীয় রাজনীতির সৌন্দর্য হলো বিতর্ক। কিন্তু সংসদে এখন আর বিতর্ক হতে দেখা যায় না। তবে আশা করছি অতীতের সৌন্দর্য আবার ফিরে আসবে।
বিশ্বের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন আইনসভা : বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন পৃথিবীর দৃষ্টিনন্দন আইনসভা ভবনের একটি। রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার আয়তন ২১৫ একর। দৃষ্টিনন্দন এ ভবনের নক্সা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত স্থপতি লুই আই কান। সংসদ ভবন এলাকাকে প্রধান ভবন, দক্ষিণ প্লাজা ও প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা এই তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। সংসদের পেছন দিকে ক্রিসেন্ট লেক নামে একটি নান্দনিক জলাধার রয়েছে। সংসদের মূল ভবনের পাশাপাশি রয়েছে উন্মুক্ত সবুজ পরিসর, মনোরম জলাধার ও সংসদ সদস্যদের কার্যালয়। ১৯৬১ সালে ৯তলা এ ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ইতিহাসের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এ ভবনের উদ্বোধন করা হয়।
‘সংসদে বঙ্গবন্ধু’ ও ‘মুজিববর্ষ বিশেষ অধিবেশন’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন : জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সংসদে বঙ্গবন্ধু’ ও ‘মুজিববর্ষ বিশেষ অধিবেশন’ শীর্ষক দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার সংসদের বিশেষ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে একাদশ জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করেন। সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পর ক্ষমতা না দেয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধু জাতিকে উপহার দেন সংবিধান। এরপর, ৭ মার্চ ১৯৭৩ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এটি বিশ্বে বিরল। কমিটির সভাপতি জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে কমিটির সদস্য বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ওবায়দুল কাদের, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, ডেপুটি স্পিকার মো. শামসুল হক টুকু, আনিসুল হক, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বৈঠকে অংশ নেন। ৫০ বছর পূর্তি ‘সুবর্ণজয়ন্তী’ উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশন বেলা ১১টায় শুরু হয়। ৯ এপ্রিল পর্যন্ত এই অধিবেশন চলবে বলে কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। ৭ এপ্রিল বেলা ৩টায় এবং ৮ ও ৯ এপ্রিল সকাল ১০টায় অধিবেশন শুরু হবে। এ অধিবেশনে ‘সুবর্ণজয়ন্তী’ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ শুক্রবার বেলা সোয়া ৩টায় স্মারক বক্তৃতা দেবেন।