বারবার পাচ্ছেন মনোনয়ন

সংকটের মুখে বিকল্প নেতৃত্ব

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম প্রকাশিত: এপ্রিল ১১, ২০২৩, ১১:৫০ এএম
  • একই ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকছে দলীয় সিদ্ধান্ত 
  • ক্লিন ইমেজ ও জনপ্রিয়দের সংসদে চায় তৃণমূল 
  • ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নে প্রয়োজন তরুণ নেতৃত্ব 
  • চ্যালেঞ্জের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন জনপ্রিয়তা দেখে

এমপিদের বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে নীতিনির্ধারণী ফোরামে নিশ্চয়ই আলোচনা হয় 
—এস এম শাহজাদা হোসেন, সংসদ সদস্য, পটুয়াখালী-৩

জনগণ চায় ক্লিন লোক কিন্তু নমিনেশনের সিস্টেমে এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না 
—এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার

নমিনেশন পেতে ডু অর ডাই সিচুয়েশন তৈরি হয়ে যায় —নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ চেয়ারম্যান, জানিপপ

জনসম্পৃক্ততা নয়, জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সম্পদ অর্জন আর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই যেন এখন মুখ্য বিষয়। জনপ্রতিনিধিদের হাভাতে এমন আচরণে চির ধরছে জনগণের সাথে যুগযুগ ধরে বিরাজমান রাজনৈতিক সুসম্পর্কে। রাজনীতি ও রাষ্ট্রের জন্য যা অশনিসংকেত —বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বর্তমান সময়ে জনপ্রতিনিধিদের রাজনীতি বিধ্বংসী এমন মনোভাব কিংবা আচরণকে উসকে দিচ্ছে বারবার একই ব্যক্তিতে তুষ্ট কিংবা সীমাবদ্ধ দলীয় সিদ্ধান্ত। দেশের রাজনীতিতে এই চর্চা এখন তুঙ্গে।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান এই চর্চায় জনপ্রতিনিধিদের জনবিচ্ছিন্নতা দেশের বেশির ভাগ আসনে এতটাই বিরূপ আকার ধারণ করেছে, যেখানে যেকোনো সময় ঘটতে পারে জনক্ষোভের বিস্ফোরণ। শুধু তাই নয়, বর্তমান রাজনীতিতে চলমান এই চর্চা এখনই বন্ধের উদ্যোগ না নিলে যেকোনো সময় জনবিস্ফোরণে যেমন মলিন হতে পারে হাজারো উন্নয়নের কৃতিত্ব, তেমনি সংকটে পড়তে পারে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি ও সুস্থ রাজনীতি। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই জনবিচ্ছিন্নতার বিরূপ প্রভাব অনেকটাই প্রকাশ্য বিষয়। পাশাপাশি জোরালো হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও। সংসদীয় অসংখ্য আসনে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক হালহকিকত প্রায় একই।

আসনভিত্তিক খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই ব্যক্তিকে বারবার দলীয় মনোনয়ন দেয়ায় সংশ্লিষ্ট আসনগুলোতে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। যদিও এখনই প্রকাশ্যে এর বিরোধিতাও করছেন না তারা। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে দাগ পড়ার ভয়ে বিরোধিতা না করলেও বিভিন্ন ইস্যুতে গোপনে দলের মনোনীত সেসব সাংসদের বিরুদ্ধে জনগণকে বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। যেকোনো সময়ই এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যেতে পারে। অন্যদিকে দল থেকে বারবার মনোনয়ন পাওয়া সেসব সাংসদরাও তোয়াক্কা করছেন না এসবের।

উল্টো নির্বাচিত হওয়ার পর অনেক সাংসদই বিশেষ কারণ ছাড়া থাকছেন এলাকাবিমুখ। সংক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরাও সেসব সাংসদদের এলাকা বিমুখিতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের পক্ষে গড়ে তুলছেন জনমত। রাজনীতির এই ধারায় যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি যেমন কঠিন হয়ে পড়বে তেমনি দলের কঠিন সময়েও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের আবির্ভাব ঘটতে পারে। যা দলকে সংকটময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে এবং একটি গোছানো রাজনৈতিক দলকেও এলোমেলো করে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অথচ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে নির্বাচনি এলাকার জনগণের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বারবার নির্দেশনা দেয়ার পরও অনেক সাংসদই মানছেন না সেই নির্দেশনা। জনসম্পৃক্ততার চেয়েও অর্থ উপার্জন আর দূরে থেকেও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনীতিই করছেন তারা। এ ছাড়াও পুনরায় দলীয় মনোনয়ন লাভে দৌড়ঝাঁপ করছেন। করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের বন্দনা।

এ ছাড়াও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, শতাংশ হারে টেন্ডার প্রতি অর্থ আদায় ও পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ স্থানীয় নেতাকর্মীরা। স্থানীয় সরকার পরিচালনাসহ সব ক্ষেত্রেই কতিপয় সাংসদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের মানসিকতায়ও ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন সময়ে কোনো কোনো এমপির বিরুদ্ধে নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের সংবাদ সম্মেলনেও উঠে এসেছে এসব বিষয়। সাংসদদের দুর্নীতি-টেন্ডারবাজিসহ নানা অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে ধরে দলীয় কার্যালয়েও অসংখ্য চিঠি দিয়েছে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েও ক্ষোভের পাত্র হয়েছেন অনেক সাংসদ। নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে অবস্থান আর নিজের পছন্দের প্রার্থী ও আত্মীয়কে বিজয়ী করার জন্য ভূমিকা রাখাও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় সাংসদের বৈরিতার অন্যতম কারণ।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে এবং বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হলে ক্লিন ইমেজের এবং নতুনদের সুযোগ দিতে হবে স্বাভাবিক পথে। তারা বলছেন, সংসদ সদস্যের কাজ জনগণের জন্য আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ কাজের চাইতে এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও নানাভাবে অর্থ উপার্জনেই বেশি আগ্রহী। এতে এমপিদের মূল কাজ ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে বৈরিতা।

এ অবস্থা চলতে থাকলে, ছড়াতেও থাকবে সংকটের ডালপালা। যে সংকট ক্ষমতাসীন দলকেও করে তুলতে পারে বিপর্যস্ত। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বের বিকল্প নেই —বলছেন বিশ্লেষকরা। সে ক্ষেত্রে ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদের শেষ বর্ষ চলছে দলটির। কয়েক মাস পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সম্ভাব্য এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনে তৎপরতা দেখাচ্ছে দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতারাও। স্বভাবতই নির্বাচন আসলে দলীয় মনোনয়ন পেতে লবিং-তদবিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতারাও পছন্দের প্রার্থীর দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিতে নিজস্ব অবস্থান থেকে তৎপরতা চালান।

আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো কোনো নির্বাচনি আসনে একজন প্রার্থী টানা পাঁচ থেকে ছয়বারও দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া কোনো কোনো রাজনীতিক ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। হয়েছেন এমপিও। ফলে ওই সব এলাকায় আওয়ামী লীগের বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। সুযোগ পায়নি নতুনরা। দলটির তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ একটি বিশাল রাজনৈতিক দল। প্রতি আসনেই এমপি হওয়ার মতো একাধিক যোগ্য ব্যক্তি রয়েছে, কিন্তু একই ব্যক্তি বারবার মনোনয়ন পাওয়ায় নতুন নেতৃত্ব বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নয়নেও গতি হারাচ্ছে। তা ছাড়া মনোনয়ন পাওয়া অনেকেই এমপি হওয়ার পর এলাকার তৃণমূল মানুষের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না।

সমস্যাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান না। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কাছে পায় না তাদের। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিরক্তি তৈরি হচ্ছে এসব জনপ্রতিনিধিদের ওপর। এলাকাবাসীর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার নির্দেশ দেয়ার পরও অনেকে তা মানছেন না। তৃণমূল নেতারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়ন করতে হলে বিকল্প নেতৃত্ব বা নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির বিকল্প নেই। নতুন ও বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণরাই বেশি শক্তিশালী, তাদের সামনে আসার, নেতৃত্বে আসার সুযোগ দিতে হবে।

শুধু নেতৃত্ব নয়, দুর্নীতিসহ নানান অভিযোগও রয়েছে কোনো কোনো এমপির বিরুদ্ধে। আইন প্রণয়নই একজন সাংসদের কাজ হলেও তারা দূরে থেকেও নিজের পছন্দসই লোকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন এলাকার সব কাজ। সামাজিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কমিটিও এখন সাংসদের নিয়ন্ত্রণে। কাবিখা প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ, বাঁধ ও রাস্তা, নালা, নর্দমা খনন-সংস্কার, ধর্মীয়, শিক্ষা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান সংস্কার বা মেরামত, স্যানিটারি ল্যাট্রিন, বাঁশের সাঁকো নির্মাণ, বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য এলাকাভিত্তিক গভীর নলকূপ স্থাপনও হচ্ছে না সাংসদদের ইচ্ছার বাইরে। এতে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন স্থায়ী সরকার প্রতিনিধিরাও (উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস-চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্য)। আরও অসংখ্য অনিয়ম রয়েছে সাংসদদের; যা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার আগে বিবেচনায় না নিলে অতীতের চেয়ে বিপরীত অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে বৃহৎ এই দলটি।

সাংসদদের প্রতি তৃণমূলের ক্ষোভের আরও একটি কারণ সরাসরি নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে কমিশনের ফলাফল বিশ্লেষণে জানা যায়, নৌকা প্রতীকের ৪৪ শতাংশ চেয়ারম্যান প্রার্থী স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। আর এর নেপথ্যে ছিলেন স্থানীয় সাংসদরা। দলের দেয়া প্রতীকের বিরুদ্ধে এমপির কর্মী-সমর্থকরা সক্রিয় তো ছিলেনই না উল্টো এমপির আত্মীয় বা পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্যই প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। ফলে ওই সব এলাকায় এমপি জিতলেও হেরেছে নৌকা। ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি নোয়াখালীর চৌমুহনী পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপির ভাইয়ের কাছে নৌকার প্রার্থী হেরে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। নৌকার বিপক্ষে এমপির কৌশলগত অবস্থানের কারণেই দলীয় প্রার্থী হেরেছে বলে অভিযোগ করেন দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে গত বছর ইউপি নির্বাচনে নৌকা ঠেকাতে স্বতন্ত্রপ্রার্থীর জনসভায় আনারসে প্রকাশ্য ভোট চান নোয়াখালী-৪ (সদর-সূবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। মোবাইলে স্বতন্ত্রপ্রার্থীর জনসভায় নৌকার বিরুদ্ধে মাইকে এমপি একরামুলের দেয়া বক্তব্যের ১০ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের একটি অডিও ফাঁসও হয়। দেশজুড়ে এমন অসংখ্যা উদাহরণ রয়েছে।  

এসবের রেশ টানা না গেলে আগামী নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। জনসম্পৃক্ততা রয়েছে এমন ব্যক্তিকেই সংসদে দেখতে চান তারা। যদিও সাংসদদের অনেকেই চলছেন পুরো উল্টো পথে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর চাইতে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিতেই বেশি সময় ব্যয় করছেন তারা। যদিও এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গত ৩০ মার্চ গণভবনে বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জিং। অবশ্য তিনি এও বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুখ দেখে কাউকে মনোনয়ন দেবেন না। জনপ্রিয়তা দেখেই সিদ্ধান্ত নেবে দলের মনোনয়ন বোর্ড।

ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা মনে করেন, এখন যারা এমপি রয়েছেন তাদের অনেকেই হয়তো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন না। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে (সবাই নন) অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন। এলাকার উন্নয়নে তারা প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখেন না। আমার সংবাদকে তিনি বলেন, বর্তমান এমপিদের মধ্যে অনেকেই বাদ যাবেন, যাদের রিপোর্ট খারাপ তারা বাদ যাবেন। তাদের স্থলে দীর্ঘদিন ধরে পদবঞ্চিতদের মধ্যে যোগ্যরা এবং দলের জন্য যাদের ডেডিকেশন রয়েছে তারা মনোনয়ন পাবেন। তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রেই যে দলীয় প্রতীকের কারণে ভোট পাওয়া যায় তা কিন্তু নয়, প্রার্থীর নিজস্ব ইমেজের কারণেও ভোটের হিসাব পাল্টায়। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকেরই ইমেজ নষ্ট হয়ে গেছে। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির তার জেলার বিষয়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ভালোভাবে অবগত আছেন বলে জানান। তিনি বলেন, কে কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছে তাও শেখ হাসিনার জানা।

ফলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ জেলায় কাকে দলীয় মনোনয়ন দিতে হবে সেটি তার (শেখ হাসিনা) ভালোভাবেই জানা আছে। তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন বলে বিশ্বাস করেন জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা। হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী আমার সংবাদকে জানান, তিনি আগে দুইবার হবিগঞ্জ-১ আসনে (নবীগঞ্জ-বাহুবল) দলীয় মনোনয়ন চেয়েছেন। আগামীতেও চাইবেন। তিনি দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য এলাকার সর্বস্তরের মানুষের পাশে রয়েছেন। সুযোগ পেলে নতুনরা ভালো করবে বলে মনে করেন তিনি। 

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদ দারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি এমপি হয়েছেন, আবারও দলের টিকিট চাইবেন। তিনি বলেন, আমি দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রধান বুঝে শুনেই দলের মনোনয়ন দিবেন। 

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে বলেন, ক্লিন পলিটিক্যাল লোক তো সবাই (জনগণ) চায়, তারা কী (রাজনৈতিক দল) দেয়? দেয় না। রাজনৈতিক দলগুলো যাকে ভালো মনে করে তাকেই মনোনয়ন দেয়। এখানে আর কী আশা করা যাবে? এর চাইতে ভালো কিছু আশা করা যায় না। 

যেভাবে আমাদের নমিনেশন সিস্টেম আছে তাতে এর চাইতে বেশি কিছু আশা করা যা না। সম্ভাব্য কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেও তারা (রাজনৈতিক দল) মনে করে এগুলো রাজনৈতিক, ফলে এর চাইতে আর বেশি কিছু বলারও নেই। পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা ও গলাচিপা) আসনের সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদা হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন বোর্ড অত্যন্ত অভিজ্ঞ, তারা সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তিকেই দলীয় মনোনয়ন দিয়ে থাকেন।

বর্তমান সংসদ সদস্যদের কারো কারো বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম এবং বিভিন্ন সময় তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো নিয়ে দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা বা আত্মসমালোচনা হয় কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে আত্মসমালোচনা করি। দলের যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, (নীতিনির্ধারণী ফোরামে) তাদের ফোরামে এসব বিষয়গুলো নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা হয়। তিনি বলেন, মনোনয়ন সংক্রান্ত কোনো সভা বা মিটিংয়ে এখনো আমাকে ডাকা হয়নি, ডাকলে তখন এসব বিষয় নিয়ে কথা বলব কি-না সে চিন্তা করব।  

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ মনে করেন, একজন সৃজন পলিটিশিয়ান জনসম্পৃক্ত থাকবেন এটিই প্রত্যাশিত, আর তাত্ত্বিক বিবেচনায় এলাকার উন্নয়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব জনপ্রতিনিধি হিসেবে যিনি সংসদে রয়েছেন তার নয়, তিনি মূলত আইন প্রণেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি যিনি আছেন বা যারা আছেন, যেমন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা সদস্যরা উন্নয়ন নিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে তাদের। 

আমার সংবাদকে তিনি বলেন, এখন দল নির্বিশেষ আমরা দেখেছি, প্রতিবার নির্বাচনের আগে বিশেষ করে বড় দলগুলোতে এই নমিনেশন নিয়ে রীতিমতো ডু অর ডাই একটা সিচুয়েশন তৈরি হয়ে যায়। এবং এটার একটা কারণ হচ্ছে- সমাজে একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে জিরো থেকে হিরো হওয়ার, রাতারাতি প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার। সেই অর্থ ও বিত্ত ধরে রাখার জন্য দরকার ক্ষমতা এবং ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য একটা পেরেশানি তৈরি হয়। বলা যায়, ডেসপারেট, অর্থাৎ যেকোনো মূল্যে এ দায়িত্ব নিতে হবে এবং সে জন্য খুনখারাবি থেকে শুরু করে আপনার যত রকমের অপকৌশল আছে তা অনেক সময় গ্রহণ করা হয়। অর্থের যে ছড়াছড়ি সেটা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইন প্রণেতা হিসেবে সংসদে আইন পাস করার যে ভূমিকা সেটাতেই তারা নিজেদের নিয়োজিত রাখবেন, এ ব্যাপারে যত মুনশিয়ানা অর্জন করা যায়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করা যায়, এ বিষয়ে যদি তারা মনোযোগী হন তাহলে আমরা জাতি হিসেবে গণমুখী আইন ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সক্ষম হবো। তা না হলে গণভোটে পাস হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো ঘটবে এবং ডিবেট (বিতর্ক) পার্লামেন্ট ডিবেট সেটি হয়তো তুলনামূলকভাবে কম মাত্রায় ঘটবে। সে জন্যে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা যেমন সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের থাকতে হবে এবং যারা নির্বাচকমণ্ডলী বা ভোটার তাদের যে প্রত্যাশা সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।