বর্তমানে নারীরা ব্যাংকে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও ভালো বেতনকাঠামোর ফলে এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ দিনদিন বাড়ছে। বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে বসে নেতৃত্বও দিচ্ছেন তারা। আবার ব্যাংকের নীতিনির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন অনেক নারী। এক বছরে এ খাতে নতুন কর্মী বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ। তবে পারিবারিক দায়িত্বের চাপে ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে ব্যাংক ছাড়ছেন অনেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জেন্ডার ইকোয়ালিটি বিষয়ক ষান্মাসিক প্রতিবেদনে এ চিত্র দেখা গেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে নারীকর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৯৩৯ জনে। ২০২১ সাল শেষে সংখ্যাটি ছিল ৩০ হাজার ১৪১। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে নারীকর্মী বেড়েছে এক হাজার ৭৯৮ জন বা ৬ শতাংশ। বর্তমানে ব্যাংকে নারীকর্মীর হার ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ছিল ১৬ দশমিক ০৩ শতাংশ। ব্যাংকে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবেও নারীদের দেখা যাচ্ছে। যেমন বর্তমানে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হুমায়রা আজম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের পরিসংখ্যান বলছে, ব্যাংকে যারা ক্যারিয়ার শুরু করছেন, তাদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ নারী। এক বছর আগে যা ছিল ১৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ব্যবস্থাপনার মধ্যম স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ স্তরে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে; এক বছর আগে ছিল ১৬ শতাংশ। আর ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে ৯ দশমিক ২২ শতাংশ নারী। ২০২১ সাল শেষে এ সংখ্যা ছিল ৯ দশমিক ৩৭। অর্থাৎ উচ্চপর্যায়েও নারীদের অংশগ্রহণ কিছুটা কমেছে। সে হিসাবে এক বছরে ব্যাংক খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নেতৃত্ব কিছুটা কমেছে। যদিও বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য নয়।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ দেশের ব্যাংক খাতে বোর্ড সদস্য বা পরিচালক হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণ ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০২১ সালে ছিল ১৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর চার বছর আগে ২০১৮ সালের একই সময়ে এই হার ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ নীতিনির্ধারণে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি ব্যাংকগুলোয় নীতিনির্ধারণের জন্য পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। নারী উদ্যোক্তা, সাবেক নারী ব্যাংকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় মালিকদের স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূ ও ঘনিষ্ঠজনদের পরিচালক হিসেবে দেখা যায়।
সরকার সমপ্রতি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগসংক্রান্ত নতুন এক নীতিমালা করেছে। সেই নীতিমালায় বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের এক-তৃতীয়াংশই থাকবেন নারী। এ ছাড়া সরকারের শেয়ার রয়েছে, এমন বেসরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক দৌলতুন্নাহার খানম গণমাধ্যমকে বলেন, এটা শুধু দেশের ব্যাংক খাতের জন্য নয়, সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত। তবে খেয়াল রাখতে হবে, শুধু কোটা পূরণের জন্যই যেন যে কাউকে বোর্ডে বসানো না হয়। একটু খুঁজলেই ব্যাংক খাতে নেতৃত্ব দেয়ার মতো দক্ষ নারী পাওয়া যাবে। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা থাকতে হবে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংখ্যায় বেশি হওয়ায় ব্যাংকে নারীদের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় অংশীদার হলো দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বর্তমানে প্রায় ৩২ হাজার নারী ব্যাংক খাতে কর্মরত আছেন। এর মধ্যে ২১ হাজারের বেশি কাজ করছেন দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সংকট ও পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমে এসেছে। সরকারি ব্যাংকের নিয়োগপ্রক্রিয়াও চলছে ধীরগতিতে। তা না হলে পরিস্থিতির আরও পরিবর্তন হতো।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, পড়ালেখা শেষ করে ব্যাংকগুলোয় প্রচুর নারীকর্মী যোগ দেন। কিন্তু পরে তাদের একটা অংশ চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মূলত কাজের চাপ সামলাতে না পারা ও সন্তান লালন-পালনের জন্য ব্যাংকের চাকরি ছাড়েন তারা। সে জন্য উচ্চপর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ যেভাবে এগোনোর কথা ছিল, ঠিক সেভাবে এগোচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, নারীদের জন্য দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকে ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি কার্যকর হচ্ছে। এসব ব্যাংকে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা আছে। ৩৩টি তফসিলি ব্যাংক তাদের কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র স্থাপন করেছে। নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ৩২টি ব্যাংকের আছে নিজস্ব পরিবহন সুবিধা।
নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাংকিংয়ের বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে উল্লেখ করে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান গণমাধ্যমকে বলেন, ১০ থেকে ১৫ বছর আগে এই যাত্রা শুরু হয়। তখন এমন হয়েছে, অনেক নারীকে ডেকে এনে ব্যাংকে বসানো হয়েছে। শুরুতে এটা প্রয়োজন ছিল। না হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যে সমানতালে ব্যাংকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এই পরিস্থিতি দেখা যেত না। সমান সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণ পাওয়ার ফলে সামনের দিনে নারীরা আরও ভালো করবেন।
কয়েকটি ব্যাংকের নারীকর্মীরা জানান, ব্যাংকের পর্যাপ্ত শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র ও যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকলে নারী ব্যাংকারের সংখ্যা আরও বাড়ত। শীর্ষ পর্যায়ের অনেক পদে নারী কর্মকর্তাদের দেখা যেত। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদকেও উদ্যোগ নিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেশে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। প্রতিযোগিতামূলক সব কাজে উল্লেখযোগ্য হারে নারীর অংশগ্রহণ ও সাফল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যাংক খাতেও এর প্রতিফলন হয়েছে। তাই দিনদিন নারী ব্যাংকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ তিনি বলেন, আর্থিক খাতে নারীর যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তৎপর রয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ আলাদা বিশ্রামাগার ও ইবাদতখানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র স্থাপন, মাতৃত্বকালীন ছুটি কার্যকর এবং নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত তদারকি করছে।