চিনির দাম নিয়ে চলছে ইঁদুর বিড়াল খেলা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে বৈঠক করে চিনির দাম নির্ধারণ করছেন চিনি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। ইতোমধ্যে দুই দফা দাম নির্ধারণ করেও কার্যকর করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ী সমিতি। বরং দাম নির্ধারণের পর বাজার আরও চড়া হচ্ছে। এক কথায় উল্টো পথে চিনির বাজার।
তাই ভোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন— চিনির বাজার আসলে কে নিয়ন্ত্রণ করছে। কার্যকরের ব্যবস্থা না নিয়ে বারবার দাম নির্ধারণ করে ভোক্তাদের সাথে তামাশা করা হচ্ছে কি-না এমন প্রশ্ন ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর। গত ২৬ জানুয়ারি খোলা চিনির দাম পাঁচ টাকা ও প্যাকেটজাত কেজিতে চার টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। বর্ধিত এ দাম ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। সে হিসাবে বর্ধিত দামসহ এক কেজি খোলা চিনির দাম হওয়ার কথা ছিল ১০৭ টাকা, আর প্যাকেটের দাম ১১২ টাকা।
যা দাম বৃদ্ধির আগে ছিল ১০২ টাকা ও ১০৮ টাকা। কিন্তু এ দাম নির্ধারণের আড়াই মাসেও কার্যকর হয়নি। বাজারে যথারীতি ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় খোলা চিনি বিক্রি হয়। আর প্যাকেট চিনি বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। আবার কোথাও কোথাও ঠিকানাবিহীন ভুয়া কোম্পানির নামে প্যাকেট করে বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর দোকানগুলোতে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই দাম কিছুটা কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
কারণ হিসেবে বলা হয়— রমজান উপলক্ষে চিনির বাজারে অস্থিরতা কমাতে আমদানি পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চিনির দাম কমিয়ে পরিশোধিত খোলা চিনি কেজিপ্রতি ১০৪ টাকা ও পরিশোধিত প্যাকেটজাত চিনি ১০৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম নিয়ন্ত্রক মোছা. শামীমা আকতার স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি সংশ্লিষ্টদের পাঠানো হয়েছে।
এ সিদ্ধান্ত গত শনিবার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু নতুন দাম কার্যকর দূরে থাক; বাজারে উল্টো চিনির দাম বেড়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যমতে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাম কমানের সিদ্ধান্ত জানানোর দিনই (৬ এপ্রিল) চিনির দাম নতুন করে বেড়েছে। এক দশমিক ৩৪ শতাংশ বেড়ে চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১২ থেকে ১১৫ টাকায়, যা আগে ছিল ১১০ থেকে ১১৪ টাকা। রোজার শুরুতে চিনির কেজি ছিল ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। অর্থাৎ রোজার মধ্যেই চিনির দাম কিছুটা কমার পর এখন আবার বাড়ল। যদিও সরেজমিন তথ্য নিয়ে দেখা গেছে টিসিবির প্রকাশিত দামের চেয়েও আট থেকে ১০ টাকা বেশি দাম বাজারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে ব্যবসায়ীদের নিজেদের ঘোষিত দামই কার্যকর হয়নি; সেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া দামের কোনো প্রভাব বাজারে পড়বে না। বাস্তবে তা পড়ছেও না। তাহলে প্রশ্ন সামনে আসে, চিনির বাজারের নিয়ন্ত্রণ আসলে কাদের হাতে। গত ২৬ জানুয়ারি দাম নির্ধারণের পর জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেছিলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যেহেতু নিজেরাই একটা দাম নির্ধারণ করেছে, আমরা চাই সবাই সেটি মেনে চলুক। ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই নজরদারি বাড়ানো হবে। যদি এরপরও বেশি দামে বিক্রি হয় তখন অভিযান হবে।’
কিন্তু দাম কার্যকরে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ভোক্তা অধিকার। গত ২৩ মার্চ এফবিসিসিআই আয়োজিত মতবিনিময় সভায় চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মফিজুল হক বলেন, চিনির দর মিলগেটে ১০২ টাকা বেঁধে দিলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো ১০৬ বা ১০৭ টাকা নিচ্ছে মিলগেটে। তা ছাড়া মিল পর্যায়ে থেকে চিনি দিচ্ছে না। বাজারে এখনো চিনির ঘাটতি। এর সমাধান হওয়া জরুরি। এ অভিযোগের সত্যতা জানতে এফবিসিসিআই সভাপতি সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সিটি, মেঘনা ও এস আলম গ্রুপের কাছে পণ্যের মজুত পর্যাপ্ত। গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখলে উৎপাদনও ঠিক থাকবে। পণ্যের সংকট হবে না, দামও বাড়বে না। এমন পালটাপালটি দোষারোপের মধ্যেই সভা শেষ হয়। চিনির দাম বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে দায় চাপান সংগঠনটির নেতারা।
গত ১৮ মার্চ বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা কামাল আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমদানি শুল্ক ছাড়ের চিনি দেশে আসলে পরিস্থিতির উত্তরণ হবে।’ কিন্তু শুল্ক ছাড়ের চিনি দেশে আসার পরও দাম কমেনি। এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল একধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী বাজার অস্থির করে তুলে। বাজারা তদারকি শক্তিশালী করার মাধ্যমে এ ধরনের সমস্যা সমাধান সম্ভব।’
টিসিবির তথ্যমতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। বাজার বিশ্লেষণ করে টিসিবি যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে গত ৪ এপ্রিল। ১১ দশমিক ১১ শতাংশ বেড়ে ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২১০ টাকা। আগে যা ছিল ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা। অবশ্য মাঝে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৮০ টাকাও বিক্রি হয়েছে। চিনির মতো ব্রয়লার মুরগির দামও রোজার মধ্যে কিছুটা কমে এখন আবার বেড়েছে।
টিসিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খোলা পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ৭ এপ্রিল। ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেড়ে খোলা পাম অয়েলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা, যা আগে ছিল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। ধনিয়ার দাম বাড়ে ৬ এপ্রিল। ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা, যা আগে ছিল ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা। দেশি ও আমদানি করা উভয় ধরনের হলুদের দাম বেড়েছে ৬ এপ্রিল। দেশি হলুদের দাম ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৯০ টাকা। আগে যা ছিল ২০০ থেকে ২৪০ টাকা। আমদানি করা হলুদের দাম ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২৩০ টাকা, যা আগে ছিল ১৯০ থেকে ২২০ টাকা। তবে কয়েকটি পণ্যের দাম সামান্য কমেছে। প্যাকেট ময়দার দাম কমেছে গত ২ এপ্রিল। ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ কমে প্রতি কেজি প্যাকেট ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৫ টাকা, যা আগে ছিল ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা। একই দিন কমেছে খোলা সয়াবিন তেলের দাম।
শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ কমে খোলা সয়াবিন তেলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ থেকে ১৭৫ টাকা, যা আগে ছিল ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা। দেশি রসুনের দাম কমেছে ৪ এপ্রিল। ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ কমে দেশি রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা, যা আগে ছিল ৯০ থেকে ১২০ টাকা। এর দুদিন আগে অর্থাৎ ২ এপ্রিল কমে আমদানি করা রসুনের দাম। ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ কমে আমদানি করা রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, যা আগে ছিল ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা। ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমে এক হালি ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা, যা আগে ছিল ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা।