নতুন টাকা বিনিময়ে গ্রাহকের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে লেনদেনে অনীহা সৃষ্টি হওয়ায় চাপ বাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাড়তি চাপ সামাল দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেও ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে পাঁচটি কাউন্টারের বিপরীতে মাত্র একটি শ্লথ গতির ডিজিটাল মেশিনে টোকেন দেয়া হচ্ছে। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে গ্রাহকদের।
অন্যদিকে ফাঁকা কাউন্টারে অলস সময় পাড় করছেন ক্যাশ ম্যানেজাররা। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ধৈর্য হারিয়ে বিশৃঙ্খল ও উত্তেজিত আচরণ করছেন অনেকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যাংকের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীদের পাশাপাশি তৎপরতা বাড়িয়েছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের ধারণার চেয়ে কয়েকগুণ মানুষ ভিড় করছে। তাই চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। তবে বাড়তি চাপ সামলাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। তারা বলছেন, পাঁচটি কাউন্টারের বিপরীতে মাত্র একটি মেশিনে টোকেন দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অন্তত আরও একটি মেশিন বৃদ্ধি করলে ভিড় অনেকটা কমে যেত। এ ছাড়া স্থাপিত মেশিনটি খুবই ধীরগতির হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। মনসুর নামের একজন বলেন, সকাল ১১টায় লাইন দাঁড়িয়েছি। এখনো সামনে ৩০ জনের মতো আঙ্গুলের ছাপ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কয়টায় নতুন টাকা পাব তা জানি না। পুরো দিন পার হয়ে গেল টাকা নিতে এসে। নিয়ম অনুযায়ী একজন ব্যক্তি একবারের বেশি নতুন নোট নিতে পারবে না। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট নিতে আসা প্রত্যেক ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে রাখছে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে। সেই মেশিনে প্রথমে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ দিলে একটি টোকেন বেরিয়ে আসবে যেখানে সিরিয়াল নাম্বার লেখা থাকে। ডান হাতের আঙ্গুলের ছাপ না উঠলে চেষ্টা করা হয় বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের।
কিন্তু মেশিনটি শ্লথ গতির হওয়ায় সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। যেখানে এই ছাপ নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় প্রয়োজন হওয়ার কথা সেখানে ৩০ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট সময় পর্যন্ত লাগছে। আবার চার মিনিটও লেগেছে দুজনের আঙ্গুলের ছাপ নিতে। কখনো দেখা গেছে এ প্রক্রিয়ায় একজনের ন্যূনতম ১৫-২০ সেকেন্ডেও হয়ে যাচ্ছে। তবে বেশিরভাগের ক্ষেত্রে সময় লাগছে বেশি। আবার কখনো মেশিন আঙ্গুলের ছাপ নিতে পারছে না। তখন পুনরায় চেষ্টা করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা ও তদারকি করতে গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের সাতজন কর্মকর্তাকে গলদঘর্ম হতে দেখা যায়।
একটি মাত্র মেশিনে আঙ্গুলের ছাপ নেয়ায় দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। নতুন শত শত মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা ধরে। গ্রাহকদের দাবি ভিড় কমাতে মেশিন বাড়ানোর বিকল্প নেই। কারণ পাশেই পাঁচটি কাউন্টার ফাঁকা পড়ে আছে। একটি টোকেন মেশিন স্লিপ দিয়ে কুলাচ্ছে না। নতুন নোট বিনিময় করতে আসাদের লাইন দীর্ঘ হওয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের কয়েকজন সদস্য সতর্ক অবস্থায় ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
নতুন নোট নিতে আসা ব্যক্তিদের দীর্ঘ সময়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ও দুর্ভোগের বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক জানান, ‘কারিগরি ও নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে এটি হয়েছে। আঙ্গুলের ছাপ নিতে সময় লেগেছে বেশি। যে গতিতে ইন্টারনেট পাওয়ার কথা তা না থাকায় মেশিন স্লো কাজ করেছে। আমাদের টিম কাজ করছে-সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।’ তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা সরবরাহ করেছে গ্রাহকদের বিতরণের জন্য। কিন্তু সেখানে যথাযথ উপায়ে বিতরণ হচ্ছে না। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাপ বাড়ছে।
কর্মকর্তাদের এমন দাবির সত্যতাও মিলেছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নিচ তলায় অবস্থিত মতিঝিল শাখায় গিয়ে দেখা যায়, শ’খানেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কাউন্টারে লোক নেই। গ্রাহকদের বলা হয়েছে, ক্যাশ স্টক নেই। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কেউ পাশেই বাংলাদেশ ব্যাংকে ভিড় করছেন আবার কেউ উত্তেজিত আচরণ করছেন। আরিফ হোসেন নামের একজন বলেন, ‘একেকবার একেক কথা বলা হচ্ছে। দিবে নাকি দিবে না সেটি স্পষ্ট করে বলে দিলেই পারে। আমরা কাজ ফেলে এখানে এসেছি।’ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপস্থিত না থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে প্রতিবারে ন্যায় এবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনের ফুটপাতে নতুন টাকার নোট বিক্রি করতে দেখা গিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ভিড় দেখে বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দরে টাকা নেয়ার কথা জানিয়ে নাইম কামাল বলেন, ‘ভিতরে (বাংলাদেশ ব্যাংক) বেশি ভিড়। লাইনে দাঁড়ালে অনেক সময় যাবে। তাই বেশি দাম দিয়ে বটতলার নিচে সড়ক থেকে নিলাম।’
সেনা কল্যাণ সংস্থার সামনের ফুটপাতে থাকা নতুন টাকা সাজিয়ে রাখা এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০ টাকার একটি আর ২০ টাকা নোটের একটি বান্ডিল (প্রতিটিতে ১০০ পিস) নিলেন অতিরিক্ত ৪০০ টাকা দিয়ে। বান্ডিল প্রতি ২০০ করে টাকা বেশি দিত হয় তাকে। গত বছর ১০ টাকার একটি বান্ডিল অতিরিক্ত দিতে হয়েছিল সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এবার সেখানে দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। সারা বছরই নতুন নোট অতিরিক্ত দরে বিক্রি হতে দেখা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে।
ঈদের সময় মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও ডালা সাজিয়ে বসেন। কিন্তু এবার তাদের সংখ্যা দেখা গেছে খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ছাড়াও রাজধানীর গুলিস্তান, সদরঘাট, মিরপুর, ফার্মগেট, রায় বাজার এলাকায় নতুন নোটের পসরা বসিয়ে থাকেন নিয়মিত ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। উল্লেখ্য, ঈদ উপলক্ষে প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকার ছেড়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩০ তলা ভবনের নিচ তলায় প্রতিদিন বেলা আড়াইটা পর্যন্ত একজন বিভিন্ন মানের মোট সাড়ে আট হাজার টাকার নতুন নোট বিনিময় করতে পারছেন।
গত রোববার থেকে নতুন টাকার নোট বিনিময় শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের নির্ধারিত শাখায় পাওয়া যাবে বেলা ১০টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত। ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকের ৪০টি শাখার মাধ্যমেও গ্রাহকরা নতুন নোট সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আরও বেশিও নতুন নোট ছাড়া হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একজন গ্রাহক বিদ্যমান নোট জমা দিয়ে ৫, ১০, ২০ ও ৫০ টাকা মূল্যমানের নতুন নোট নিতে পারবে সর্বোচ্চ সাড়ে আট হাজার টাকার। অবশ্য কেউ চাইলে যেকোনো পরিমাণের ধাতব মুদ্রা গ্রহণ করতে পারবে।
এবার ঈদে ১৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত কয়েক বছর ধরে পাঁচ টাকার কাগুজে নোট বাজারে ছাড়েনি বাংলাদেশ ব্যাংক। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল, ধাতব মুদ্রার প্রচলন বাড়াতে দুই ?ও পাঁচ টাকার কাগুজে নোট বাজারে ছাড়া হচ্ছে না। কিন্তু এবার সেই অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে পাঁচ টাকার কাগুজে নোটের প্রচলন ফের বাড়াতে শুরু করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।